|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বড়দের আরও সাবধান হতে হবে |
শারদীয়া পত্রিকাগুলির মধ্যে সবচেয়ে আগে বেরোয় ছোটদের কাগজ। সেটাই ঠিক - প্রথম ফুলের প্রসাদ তো শিশুদেরই দু’হাত ভরে তুলে নেওয়ার কথা। তার সম্ভারটিও বড় কম নয়। বইজগতে যে প্রকাশকের গভীর শিকড়, অনেক ডালপালা, আর যে এই সেদিন মাথা তুলেছে মাটি থেকে, দু’দলই ফুল ফুটিয়ে চলেছে। কে কেমন, তা নিয়ে আলোচনা তো চলতেই পারে। কিন্তু বছরের পর বছর কেবল ছোটদের গল্প-উপন্যাস-ছবি-ছড়া সাজিয়ে কচি-কাঁচাদের এমন নেমন্তন্ন করার রেওয়াজটা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। আজ এই শারদ পত্রিকা বা বইয়ের সম্পাদকরা তাঁদের ছেলেবেলায় এই সব শারদীয়াই পড়েছেন, কিংবা এমন অন্য কোনও পত্রিকা, সম্পাদিত বই। তাঁদের প্রকাশনার পিছনে নিজের ছেলেবেলার রস আস্বাদনের স্মৃতি কাজ করছে, বইগুলো নেড়েচেড়ে তা বেশ টের পাওয়া যায়। যখন দিয়েথুয়ে আনন্দ, আবার দু’হাত ভরে পেয়েও আনন্দ, তখনই তো উৎসবের দিন। অন্য দিনে যা পরিশ্রম, উৎসবে তাই পুরস্কার।
তা বলে সব লেখাই কি ভাল? বাঙালিরা ভাগ্যবান - আমাদের প্রায় সব শীর্ষ সাহিত্যিক শিশুদের জন্য দরাজহস্ত। তাঁরা আলগোছে, অবহেলায় ফুঁ দিলেও বাঁশিতে সুর বাজে। তখন আর পাঁচজনের সুরে-বেসুরে গলা সাধা অনেকটা সয়ে যায়। আর নতুন সুরধুনীর সন্ধান পেলে তো গোটা আকাশটাই হাতের মুঠোয়। আর ছোটদের গল্পের একটা মস্ত সুবিধে এই যে, তাকে গল্প হয়ে উঠতেই হয়। তার শুরু, মধ্যিখান, শেষ রাখতেই হবে। চাট্টি ডায়লগ শুনিয়ে, দর্শন কপচিয়ে, হা হুতাশ শুনিয়ে ছেড়ে দেওয়া, ওসব ফাঁকিবাজিকে বড়রা ‘সাহিত্য’ বলে খাতির করতে পারে, ছোটরা চোখ পাকিয়ে, ভুরু কুঁচকে বলবে, ‘তারপর কী হল?’ তাই ভাল হোক মন্দ হোক, দু-মলাট ভর্তি আস্ত আস্ত, গোটা গোটা গল্প-উপন্যাস পাওয়া যায় শরৎ এলেই।
উড়োজাহাজ ভারি ছিমছাম, সুচিন্তিত, সুনির্মিত কাগজ। প্রাক-কৈশোর শিশুদের কথাটা কেউ তেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবে না, গোয়েন্দা-ভূত-স্মৃতিকথার মধ্যে দুয়েকটা রূপকথা আর ছড়া গুঁজে দেয়। এই পত্রিকা কিন্তু শিশুদের সম্মান করেছে - অনেক ছড়া, একটা নাটক, ছোট ছোট গল্প, আর এক ছড়াকারের (শ্যামলকান্তি দাশ) প্রথম উপন্যাস। সুন্দর প্রচ্ছদ পল্লবী মজুমদারের, পরিপাটি অলংকরণ স্বয়ং সম্পাদক তরুণকান্তি বারিকের। ভাল কাগজে ঝকঝকে ছাপা, ওজন-আকারে শিশুর মাপসই, আগাগোড়া যত্নের ছাপ নজর কাড়ে।
বেশ ছড়া লিখেছেন শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ,
‘দেবার ইচ্ছে যদি হয় তবে দিও রামধনু চক্ষে
তার থেকে রঙ নিয়ে আমি যেন দিতে পারি সব লোককে’ (একটা ভাল স্বপ্নের জন্য)।
কিশোর দুনিয়া-র মেজাজটা অনেক সময়ে বই-বই হয়ে ওঠে। পত্রিকা পড়ায় বৈচিত্রের যে মজা, সেটা কমে যেতে চায়। সম্পাদক তাপস মুখোপাধ্যায় সেটা ধরে রাখতে বেশ কিছু ‘ছবি কুইজ’ আর টুকরো মজার তথ্য রেখেছেন পাতায় পাতায়। অলংকরণ, বিন্যাস ভাল হলে সেগুলো আরও হিট করত। ভ্রমণ এবং বিজ্ঞানের লেখা বিশেষ ভাবে সম্পাদকের নজর দাবি করে। তাপস অধিকারীর লেখায় পেলিক্যান-এর বাংলা নাম ‘গগনবেড়’ বলাই যখন হল, তখন শিরোনামে তাদের ‘ডিসিপ্লিনড্’ বলার দরকার কী? ও কথাটার কি বাংলা হয় না? সম্পাদক দুয়ার ধরার কাজটা ছেড়ে দিলে অন্যায় হয় - প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ের গল্পের বিষয় ও হাস্যরস ছোটদের উপযুক্ত নয়, ইংরেজিতেও ভুল রয়ে গিয়েছে।
সাহিত্যিক এবং শিল্পী ধীরেন বল এ বছর শতবর্ষে, তাঁকে নিয়ে টগবগ-এ দুটি লেখা, এবং তাঁর আঁকা ছবি প্রকাশ করে দরকারি কাজ করেছেন সম্পাদক সরল দে। মতি নন্দী, অরুণ আইনের পর খেলা নিয়ে গল্প-উপন্যাস বড় দেখা যায় না, তৃষিত বর্মণ (‘স্বপ্নরা বেঁচে আছে’) তার স্বাদ অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছেন। বলরাম বসাকের লেখায় শজারু কদমবুশ মেঘ করলে আকাশের সুরে সুর মিলিয়ে মাউথ অর্গ্যান বাজায় - সার্থক রূপকথা। প্রণব সেনের ‘অন্ধকারে রাজা’ রূপকথার মোড়কে বিশ্রী রাজনীতি। ছোটদের অপথ্য। সম্ভবত এই প্রথম রূপকথায় ‘অর্থমন্ত্রী’ এল!
একটি পাতায় তিনটি কলাম ছাপার রীতি ধরে রেখেছে শুকতারা। মাঝে স্কেল দিয়ে টানা দাগের মতো কলাম লাইন। ছড়াগুলো ডানদিকের মার্জিনে ঠাসা, ছবি দায়সারা, বিন্যাসে চিন্তার ছাপ নেই। বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা আজও না-পড়ে থাকা যায় না, সত্যজিৎ রায়ের পুনর্মুদ্রণ কিংবা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের নতুনতম মামার গল্প হাতে পেলেই পড়ে ফেলতে হয়। এই সবই আজও শুকতারার জোর। দেব সাহিত্য কুটির থেকেই চার দশক পর পুনর্মুদ্রিত মণিহার’। দুঃখের বিষয়, রঙিন ছবিগুলি ভাল ছাপা হয়নি।
কিশোর ভারতী-তে সম্পাদক ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘সেলিব্রিটির সাহিত্য’ বলে একটি বিভাগ করেছেন। ভারী আপত্তিকর। সব্যসাচী চক্রবর্তীর লেখার উপরে ‘সেলিব্রিটি ভ্রমণ’, বরুণ চন্দের লেখার উপর ‘সেলিব্রিটির স্মৃতি’, নির্বেদ রায়ের লেখার উপর ‘সেলিব্রিটির বড় গল্প’ লেখার মানে কী? বোধহয় শঙ্খ ঘোষ বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো ‘নন-সেলিব্রিটি’দের সঙ্গে এঁদের না গুলিয়ে ফেলে নির্বোধ শিশুরা, তাই। মেঘনাদ সাহার জীবনের স্কেচটি ভাল।
ছুটির মেলা-য় (সম্পা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মল বুক এজেন্সি) সম্পাদকের নিজের গল্পটি মজার— বাঁদর চুরি করছে বলে পুলিশ তাকে লক আপে ভরেছে, কিন্তু কোন আদালতে তোলা হবে বুঝতে পারছে না, এর স্যাটায়ারটা বড়দেরও মুচকি হাসাবে। কিন্তু ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় (‘রহস্যের বারমোশিয়ায়’) আবারও ঘাবড়ে দিলেন। রাতের অন্ধকারে ‘হঠাৎ নজরে পড়ল পাহাড়ের উচ্চস্থান থেকে একদল অতিকায় ভালুক ক্রমশ নীচের দিকে নেমে আসছে।’ কোনটা বেশি অসম্ভব - অন্ধকারে পাহাড় থেকে ভালুক নামতে দেখা, নাকি ‘একদল’ ভালুক নেমে আসা? আর যিনি লিখেছেন কাকা গবেষণা করে একটা মাটির দানাকে ক্লোন করে দুটো করেছেন, এ বার একটা পৃথিবীকে ক্লোন করে আর একটা পৃথিবী বানানো যাবে (সিদ্ধার্থ সিংহ, ‘ভেলাবোরা’) তাঁর ‘ক্লোনিং’ সম্পর্কে ধারণা নেই। মঙ্গলদীপ-ও (নিউ বেঙ্গল প্রেস) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বৈচিত্রময় সংকলন।
আনন্দমেলা-য় প্রশংসনীয় কাজ করেছেন অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ কাহিনীর কমিকস চিত্রায়নে। সিনেমায় যেমন ক্যামেরার এক একটা শট নেওয়া হয় এক এক কোণ থেকে, সে ভাবেই তিনি একের পর এক ছবি তৈরি করে সাজিয়েছেন। ফলে গল্প বলায় পূর্ণতা এসেছে, গতিও এসেছে। অভিজিৎ সুকুলের কুইজের সঙ্গে ছাপা ছবি উত্তর ফাঁস করে দিয়েছে। মুদ্রণ প্রমাদও ঘটেছে। ‘এইচ আই ভি ভাইরাস’ লেখা ভুল।
আলোর ফুলকি-র সম্পদ ছড়া।
অমিতাভ চৌধুরী লেখেন,
‘ভাগ্যিস আমি হইনি অন্য
হয়েছি হয়েছি, হয়েছি ধন্য।’
আমরাও, আমরাও। ‘ত্রিশ যদি হয় তিরিশ, গ্রীস কি তবে গিরীশ?’ তাঁর এমন লাইন সারা বছরের বুভুক্ষা মেটায়।
‘আজব কাণ্ড জানিস কিছু এর চেয়ে ভাই আছে
টাওয়েল গায়ে জড়িয়ে ব্যাং বাথরুমেতে নাচে’
- পঞ্চম শ্রেণির পাপিয়া সুলতানা ছড়ার ছন্দ-মেজাজ ধরে ফেলেছে। সাবাস।
শিশুমেলা-র (সম্পা: অরুণ চট্টোপাধ্যায়) এ বার সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ। ছড়া-কবিতা-গল্পে ভরপুর। আজকালকার ছেলেমেয়েরা লিখেছে দাদু-দিদাদের তারা কতটুকু কাছে পায় তা নিয়ে। ঝালাপালা-য় (সম্পা: অশোককুমার মিত্র) শিশুসাহিত্যের জাদু-কলম ছিল যাঁদের হাতে তাঁদের লেখায় ভরে উঠেছে ‘হারানো দিন চির নবীন’ পর্বটি। কবিতা-গল্প-নাটক-উপন্যাসের সঙ্গে সাদা মেঘের ভেলার মতো ভ্রমণও আছে। এ বারেও সন্দেশ-এ (সম্পা: সন্দীপ রায়) মহাশ্বেতা দেবীর গল্প ‘ন্যাদোশ এবং দুর্গাপূজা’, শঙ্খ ঘোষের ছড়া:
‘হৃদয়ে চাই বোধ তো?
সবাই সবার রক্ষাকবচ
এটাই আসল সত্য।’
ক্রোড়পত্র: সত্যজিৎ ৯০-এ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছড়া, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ইন্দ্রপ্রমিত রায় রমেশ সেন বাদল বসু সৌমেন্দু রায়ের স্মৃতি, দেবাশীষ দেবের লেখা ‘সন্দেশের আগে ছোটদের ইলাস্ট্রেশনে সত্যজিৎ’।
হাতে আরও এসেছে ‘শতদ্রু’, ‘কচিকাঁচার মুক্ত আলো’, ‘চাঁদের হাসি’, ‘হৈ হৈ’। সব ক’টিতেই ছোটরা মনে রাখার মতো কিছু খুঁজে পাবে। শৈশব গোগ্রাসে গ্রহণের সময়। বড়দের সাবধান হতে হবে সেই জন্যই। যে অমৃতের অধিকারী, তার হাতে অযত্নে, অনাদরে বাসি বোঁদে তুলে দেওয়ার শাস্তি তিনদিনের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি। |
|
|
|
|
|