চারপাশে থিম পুজোর ছড়াছড়ি। কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। তার মধ্যেও স্বাতন্ত্র্যে, আভিজাত্যে এবং সাবেক রীতিতে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে হয়ে চলা বনেদিবাড়ির পুজোগুলি আজও উজ্জ্বল। দূরদূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়-পরিজনদের ভিড়ে পুজোর ক’দিন সরগরম হয়ে ওঠে বড় বড় বাড়িগুলি। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে দর্শনার্থীরাও চলে আসেন প্রতিমা দেখতে।
শ্যামনগরের ঘটকবাড়ির পুজো এ বার ৩১৩ বছরে পড়ল। এখানকার বিশেষত্ব সন্ধিপুজোয়। সেই সময়ে ঠাকুরদালানে দেবীমূর্তির সামনে জ্বলে একটিমাত্র প্রদীপ। বাকি সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে বৃদ্ধ পুরোহিত মাটির বেদিতে বসানো দেবীমূর্তিকে প্রদক্ষিণ করেন। ভিড় জমে ওঠে ঠাকুরদালানে। বিশেষ হোমের আয়োজন করা হয়। সন্ধিপুজো উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের ফল, আমসত্ত্ব, নাড়ু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয় ‘মাওয়া ভোগ’। এ ছাড়াও পুজোর চার দিন লুচি, ছোলার ডাল, খিচুড়ির আয়োজন থাকে। দুর্গার বাহন এখানে সাদা রঙের সিংহ। মুখটা ঘোড়ার। বি টি রোডের ধারে আগরপাড়ার চ্যাটার্জিবাড়ির পুজো ‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ির পুজো’ হিসাবেই পরিচিত। এখানে পুজো শুরু হয়ে যায় প্রতিপদ থেকে। সে দিন থেকে চণ্ডীর ঘট পুজো হয়। পুজোর দিনগুলিতে ৫১ রকম পদ রান্না করেন বাড়ির মহিলারা। হকের রকম মাছ থাকে। থাকে হরেক রকম ভাজা। ঠাকুরদালানে মহিষাসুরমর্দিনীর অবস্থান। সাবেকি একচালার প্রতিমা। গড়েন কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা।
এই পরিবারের পূর্বপুরুষ কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় পুজোর সূচনা করেছিলেন। বর্তমানে পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়। ৩৩৫ বছরের এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভোগ। এঁচোড়, কচু, বিভিন্ন শাকসব্জি, মাছ, মাংস থরে থরে সাজিয়ে দেবীকে নিবেদন করা হয় পুজোর চার দিন। নবপত্রিকা স্নান করানো হয় বাড়িতেই। নবমীতে সন্ধ্যারতি দেখতে ভিড় জমে। বিজয়ার দিন এই বাড়িতে অরন্ধন।
ব্যারাকপুর কালিয়ানিবাসের কবিরাজবাড়ির পুজো ‘রাজবাড়ির পুজো’ হিসাবেই খ্যাত। পরিবারের সদস্যেরা জানান, এই পুজোর সূচনা হয়েছিল অধুনা বাংলাদেশের কালিয়া গ্রামে। পরিবারের পূর্বপুরুষ কবিরাজ ছিলেন। সম্পত্তি, প্রতিপত্তি দু’টোই ছিল এক সময়ে। তাই কবিরাজবাড়ি লোকের মুখে মুখে ‘রাজবাড়ি’ হয়ে যায়। দেশ ভাগের পরে পরিবারের লোকজন এ দেশে চলে আসেন। পুজোরও স্থানান্তর হয়। এখানকার বৈশিষ্ট্য ঘটপুজো। তা শুরু হয়ে যায় প্রতিপদে। পাশাপাশি, শাক্তমতে সাবেক প্রতিমারও পুজো হয় পরিবারের নিজস্ব পুঁথি মেনে, দশ দিন ধরে। আগে এই পুজোতে বলি প্রথা থাকলেও এখন আর তা হয় না। পুজোর চার দিনই ভোগের ব্যবস্থা থাকে। অষ্টমীর দিন ভোগ খাওয়ানো হয় পাড়া-প্রতিবেশী ও অতিথি-অভ্যাগতদের।
কালিয়ানিবাসেরই দাশগুপ্ত পরিবারের পুজোয় এখনও পাঁঠাবলি হয়। পরিবারের বর্তমান সদস্যেরা জানালেন, পুজো প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের। পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশের সেনহাটিতে থাকতেন। নরহরি কবিন্দ্রদাস নামে পরিবারের এক পূর্বপুরুষ স্বপ্নে দেবীর নির্দেশ পেয়েই পুজোর প্রচলন করেন। বাংলাদেশ থেকে চলে আসার পরে এখানে পুজো শুরু হয় ১৯৫১ সালে। এই বাড়িতেও পুজো হয় পরিবারের নিজস্ব পুঁথি মেনে। দুর্গা এখানে পূজিত হন দেবী ভগবতী রূপে। দেবীমূর্তি সোনালি রঙের। মাটির প্রতিমায় ডাকের সাজ।
মা দুর্গাকে ‘জীবনদায়িনী’ হিসাবে দেখে জগদ্দলের ঘোষবাড়ি। পারিবারিক প্রথা মেনে দেবীর সন্তানসন্ততিদের প্রচলিত রীতির থেকে আলাদা ভাবে বসানো হয়। দুর্গার বাঁ দিকে বসানো হয় সরস্বতী এবং গণেশকে। ডান দিকে, লক্ষ্মী ও কার্তিককে। দেবীর পায়ের কাছে মহিষ বা মহিষাসুর নেই। ঘোষবাড়ির বর্তমান সদস্যেরা জানান, পুজোর বয়স দেড়শো বছর। পূর্বপুরুষ লালমোহন ঘোষ একবার কঠিন ওষুখে পড়েন। পরিবারের লোকজন তাঁর সুস্থতার জন্য দেবীর কাছে মানত করে পুজোর প্রচলন করেন। তাঁরা তখন বাংলাদেশের কাউখালিতে থাকতেন। দেশ ভাগের পরে সকলে এ দেশে চলে আসেন। নানা কারণে কয়েক বছর পুজো বন্ধ থাকে। ১৯৫০ সালে পরিবারের শরিকেরা মিলে ফের পুজো চালু করেন। এখানে নবমীতে পাঁঠাবলির পাশাপাশি নয় রকমের ফল বলি হয়। আগে বাড়িতেই প্রতিমা তৈরি হত। এখন প্রতিমা কিনে আনা হয়। |