শহরের প্রান্ত যেখানে ছুঁয়েছে, সেই খানে লাল মাটির একটা পথ। যে পথের শেষ মাথায় গঙ্গাকে পিছনে রেখে একটা ঘরের পোড়ামাটির দেওয়াল। মাথায় খড়ের চারচালা। ঠিক পোড়োবাড়ি নয়, রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানুষ যে ধরনের বাড়িতে বসবাস করেন, অনেকটা তেমনই ঘরের ছবি। আর এ ঘরেই চার দিনের জন্য নবদ্বীপ শহরে আসছেন ‘অন্য’ এক দুর্গা। আয়োজনে মণিপুর দুর্গোৎসব কমিটি।
নবদ্বীপের একেবারে দক্ষিণে মণিপুরের রাজবাড়ি ছাড়িয়ে তিনকড়ি গোস্বামী মহারাজের আশ্রমের ঠিক সামনের ছোট্ট একফালি জায়গা। এখানে আকাশ, মাটি আর গঙ্গাকে ব্যবহার করে অনবদ্য এক থিম পুজোর আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের ৬২ বছরের ইতিহাসে তো বটেই, সেই অর্থে নবদ্বীপের দুর্গা পুজোতেও এত বড় আকারের থিম পুজো আগে হয়নি। এই প্রথম প্রায় দেড় লক্ষ টাকা বাজেটের মণিপুরের এই পুজোর উদ্যোক্তারা শব্দ, আলো, মণ্ডপ সব মিলিয়ে এক খণ্ড লাল মাটির গ্রামই তুলে নিয়ে আসছেন। তাই তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, পুজোর চার দিন নবদ্বীপের সব পথ গিয়ে মিশবে গঙ্গা পাড়ের ওই লাল মাটির গ্রামে।
কিন্তু প্রায় ৬০ বছরের প্রথাগত পুজো হঠা থিমের পুজোয় বদলে গেল কী ভাবে? উত্তরে ভেসে এল নানান কথা। জানা গেল এ বারের এ বার পুজোর প্রধান উদ্যোক্তারা প্রত্যেকেই কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। কেউ চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট, কেউ ইঞ্জিনিয়র, কেউ আইনজীবী, কেউ শিক্ষক তাঁদের সঙ্গে আবার ফিল্ম স্টাডির উঁচু ধাপের ছাত্রও রয়েছেন, রয়েছেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও। এঁদের মধ্যে মিল একটাই। এরা প্রত্যেকেই সমবয়সী বন্ধু। এই তরুণ তুর্কিরাই ঠিক করেন, ‘পরিবর্তন’ আনতে হবে পুজোয়।
উদ্যোক্তাদের একজন মানস সাহা বলেন, ‘‘ভাবনাটা বছর দু’য়েক ধরে মাথায় ঘোরাফেরা করছিল। আমরা সকলেই কলকাতার পুজোর সঙ্গে পরিচিত। সেখানে যখন নিজের পাড়ার পুজোর দিকে তাকাতাম বড্ড মন খারাপ করত। হয়ত বিশ্বাস করবেন না, বছর তিনেক আগেও আমাদের এই পুজোর বাজেট ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বুঝতেই পারছেন কী রকম পুজো হত! তখন আমাদের কোনও উপায়ও ছিল না। এই বছর থেকেই সেই উপায় হয়েছে। আমাদের সকলের যৌথ চেষ্টায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে মণিপুরের পুজোয়।”
কিন্তু ভাবনা বাস্তবায়িত হল কী ভাবে? ১৫ হাজার থেকে দেড় লক্ষ এই লাফটা কী ভাবে দেওয়া গেল? উত্তরে পুজো কমিটির এ বারের সম্পাদক তরুণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহা বলেন, ‘‘সদস্য চাঁদা, আর সারা বছর ধরে ভাঁড়ে জমানো টাকা, এই আমাদের আয়ের প্রধান উৎস। সঙ্গে আছে এলাকাবাসীর সাহায্য। তবে মূল ব্যয়ের সিংহভাগ কমবেশি নব্বই হাজার টাকা আমরা সদস্য চাঁদা হিসেবে এ বার দিচ্ছি।’’
অন্যদের মধ্যে সোমেশ হালদার কিংবা নিলয় সাহা বা শুভঙ্কর দেবনাথ এরা নিয়ম করে কর্মস্থল থেকে ছুটে আসছেন পুজোর কাজে। মানসবাবুর কথায়, ‘‘গত জানুয়ারি থেকে থিমের ব্যাপারে পরিকল্পনা ছকে এগোনো শুরু করেছি। প্রতিমা, মণ্ডপ, আলো, এমনকি থিম অনুযায়ী আবহ সঙ্গীত সবই খুঁজে খুঁজে বার করেছি কখনও ইন্টারনেট। কখনও শিল্পীরা আমাদের সাহায্য করেছেন এব্যাপারে। প্রায় ১২ বছর পরে নবদ্বীপের নামী শিল্পী গৌতম সাহা নবদ্বীপে দুর্গা পুজোয় আবার মূর্তি গড়েছেন। আমাদের জন্য আর পঞ্চমীর রাতে উদ্বোধনের পর এই প্রতিমা অন্য উদ্যোক্তাদের ঘুম ছুটিয়ে দেবে একথা আমরা হলফ করে বলতে পারি।’’
এতজন পেশাদার মানুষের আয়োজনে এ পুজোয় অর্থাভাব হয়ত আর নেই কিন্তু পুজোর অন্যান্য কাজ সেটা কিভাবে ম্যানেজ হচ্ছে এখানে আরও এক চমক পাড়ার ৪১ জন নানা বয়সী মহিলাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে আরও একটি কমিটি ওই দিকটা সামলাচ্ছেন তাঁরাই মহিলা কমিটির প্রধান মীরা হালদার বলেন,‘‘পুজোয় যাবতীয় আয়োজ্ন মানে কাঁচা বাজার থেকে দশকর্মার জিনিস কেনা, অন্যদিকে পুজোর জোগাড় থেকে ভোগ রান্না সব নিজেরা করছি ছেলেরা শনি রবিবার ছাড়া সময় পাচ্ছেনা তাই বাকীটা আমরা সামলাচ্ছি’’ লাল মাটির পথে রাঢ বাংলার আড় বাঁশির রুক্ষ সুর শুনতে শুনতে আলো আধাঁরির পথে প্রতিমা দর্শন নবদ্বীপের দুর্গাপুজোর পরিবর্তন সত্যিই বুঝি শুরু হল। |