ঢাকে পড়ল কাঠি: সেবক
আনন্দের
অন্য যজ্ঞে

ন্ধ দরজা বা লোহার গারদ নয়। ওঁদের পুজোর আনন্দ মাটিতে, সংস্থার প্রাঙ্গণে। সারা বছর ওঁরা মুখিয়ে থাকেন দুর্গাপুজোর জন্য। পঞ্চমী থেকে দশমীর সকাল পর্যন্ত মেতে থাকেন এক অপার আনন্দে। এই আনন্দযজ্ঞে সামিল ‘সেবক’ পরিবার।
আলোর রোশনাই আর জনকোলাহলে যখন শহর মেতেছে তখন শারদোৎসবের কাজগুলো নিজেরা করে চলেছেন এক মনে। কেউ ফল কাটবেন, কেউ আলপনা দেবেন কেউ ফুলের ডালি সাজাবেন, কেউ বা অতিথি আপ্যায়নে থাকবেন। প্রতি দিনের ডে-কেয়ারে যে প্রশিক্ষণ চলে তারই হাতের কাজে সাজানো চলছে পুজোর প্রাঙ্গণ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়াও প্রায় শেষ। আজ পঞ্চমী, সন্ধ্যায় দুগ্গামায়ের আসার অপেক্ষায় টিয়া, আয়েষা, রাহুল, রঞ্জনবাবু, আশালতাদেবীরা।
এক দিন সকলেই ভরন্ত সংসারে ছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁরা ছিলেন ‘কেমন যেন’। বাইপোলার ডিজর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজর্ডার, ডিপ্রেশান, ম্যালিক ডিপ্রেশান, পার্সোন্যালিটি ডিজর্ডার নানা অসুখ ওঁদের।
কিন্তু অসুখকে থোড়াই কেয়ার, শঙ্খ বাজিয়ে কুলোয় প্রদীপ জ্বেলে দেবীবরণের জন্য তৈরি নাচ। সপ্তমীর সকালে নাচে-গানে-আবৃত্তিতে মেতে উঠবে কমিউনিটি হল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, হিন্দি গান থাকছে অনুষ্ঠানসূচিতে। গান শোনাতে সকলেই ব্যাকুল। কেউ গাইছেন ‘অলির কথা শুনে বকুুল হাসে’, কেউ বা ‘এ গানে প্রজাপতির পাখায় পাখায় রং ছড়ায়’। আছে কাঠিনৃত্যও।
বর্ণা দেবী বললেন, “মেয়ে চলে গেলে বাবা-মায়ের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। পুজো ভাল কিন্তু তার পরে আর ভাল লাগে না।” হারিয়ে যায় ভাষা। রঞ্জনবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “আমি গেয়েছি ‘জাগো দুর্গা’, শুনেছেন?” এখানে ৬৩জন মনোরোগী আছেন।
কে জানত সার্ভে পার্কের সুরঞ্জনের কথা। ভাল অর্গ্যান বাজান। দেরাদুনের হস্টেল থেকে সোজা এখানে। পুজোয় গাইবেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। ঠাকুর আসবে, যাবে। তফাত বুঝতে পার? উত্তরে সুদীপ বললেন, “আমি কাঁসর বাজাব, টনটনাটন, টনটনাটন।” নাচতে নাচতে বলল, “থোড় আর মোচা কলাগাছের জিনিস তো। তবু মোচা এত ভাল খেতে, থোড় কেন বাজে?” হারিয়ে যায় চোখের ভাষা।
হাসপাতালে নানা উৎসব করার পিছনে এক উদ্দেশ্য ছিল। নিছক আনন্দই নয়, ‘সেবক’ পরিবার বুঝেছিল নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি আরও উন্নততর হতে পারে। কারণ মানসিক রোগী মানেই পাগল নয় এমনটাই মনে করেন মনস্তাত্ত্বিক প্রতিভা সেনগুপ্ত। বললেন, “আমাদের লড়াই ওই গারদের বিরুদ্ধেই।’’
“গুটিকয়েক রোগী নিয়ে পথ চলা শুরু। এক বার দুর্গাপুজোর সময় ঠাকুর দেখতে গিয়ে অপমানিত হন রোগী ও সংস্থার সদস্যরা। ফিরে এসে ঠিক করা হয় পুজো হবে নিজেদের অঙ্গনে। আগে ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের বিবেকানন্দ সরণিতে ছিল। শুধু মহিলাদের জন্য। এখন এখানে পুরুষ বিভাগও খোলা হয়েছে। আর এঁদের ঘিরে আমাদের আনন্দ,” বললেন সংস্থার কর্ণধার তাপসকুমার রায়।
ঠাকুরপুকুর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে সামালিতে এই সংস্থার পুজোয় সকলের আমন্ত্রণ।
ফিরে আসার সময় কানে এল “আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ।” পড়াশোনার ডিগ্রিগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আপাতত রাহুল এখন সপ্তমীর জন্য গান গেয়ে চলেছেন।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.