|
|
|
|
|
|
|
ঢাকে পড়ল কাঠি |
তুমি জাগো...
খুব অসহায় সব মুহূর্তে মনে হয় সেই দু’চোখের কথা।
না,
দু’চোখ নয়, ত্রিনয়ন। লিখছেন শোভন তরফদার |
|
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেওয়ালে দেওয়াল, কার্নিসে কার্নিস...অবশ্য মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত! কয়েকটি ত্রস্ত মুহূর্ত। এই জায়গা অনেকটা আকাশের কাছাকাছি। কলকাতার সবচেয়ে উঁচু ‘লিভিং এরিয়া’, নগরীর সব থেকে উঁচু বহুতলের উচ্চতম ধাপ, উপর থেকে গোটা শহর নীলচে, সবুজ, ধূসর মিলিয়ে কেমন স্বপ্নের মতো। আবার, আচমকা আতঙ্কও হয়। যদি সব কিছু দুলে ওঠে ফের...
যদি তছনছ হয়ে যায় সাজানো বাগানের মতো সংসার! যদি দোমড়ানো কংক্রিটের স্তূপ পড়ে থাকে ভাঙাচোরা ছবির ফ্রেমের মতো! যদি এত উঁচুর এই ঝকঝকে বসবাসকে ডাক দেয় নীচের মাটি, তখন দামি, স্নিগ্ধ এলিভেটরের চেয়েও দ্রুত নেমে যাব নীচে, ভূতলে, আসলে অতলে! মাটির এই বিচিত্র পাগলামিকে এড়াই, সাধ্য কী?
যে ভাবে দুলে উঠল পৃথিবীর এই ভূভাগ, তাতে এই সব শঙ্কা আর এড়ানো যায় না। এই ধরনের ভাবনা, বা ভয় নতুন কিছু নয়। মিনারের শীর্ষে থাকলে হঠাৎ মাটির দিকে তাকিয়ে আচমকা একটা ঘোর লাগবেই। তখন ব্যালকনির রেলিংটা আর একটু জোরে চেপে ধরে, যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলা, আসলে ভার্টিগোটা আজকাল...!
ভার্টিগো তো আছেই, থাকতেও পারে, কিন্তু ওই উঁচু থেকে নিচুর দিকে তাকানোর অনুভব! যদি হঠাৎ নেমে যাই ওই দিকে! যদি তাসের ঘরের মতো তুবড়ে যায় এত কিছু...! মাঝে মাঝে কয়েকটি ঝটকার মতো সতর্কবার্তা তো পাওয়া যায়! এই যেমন, মাত্র কিছু দিন আগে...বিকেল ছুঁয়েছে ছুটির আলসে বেলা, ঠিক তখন কেঁপে উঠল ভূমিভাগ!
ভয় হয়। মনে হয় তোমার কথা। তোমার দু’চোখের কথা।
না, দু’চোখ নয়, ত্রিনয়ন।
তার পর মনে মনে, প্রায় অস্ফুটেই বলা, তুমি জাগো!
এই হাড়-হিম শিহরণ যে শুধু মাটি কেঁপে উঠলেই তা তো নয়! অন্য ভাবেও তো কেঁপে উঠতে পারে পায়ের নীচের মাটি। যেমন, সে দিন ছাত্ররা স্কুলে যাওয়ার বেশ খানিক পরে আচমকা অভিভাবকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন। স্কুলে নেই! যারা স্কুলে এসেছিল, তারা অনেকেই স্কুলে নেই! মুহূর্তে পায়ের তলার মাটি হাট হয়ে খুলে গেল যেন! মাথার ভিতরে, দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা তেতো হাওয়া। চক্ষু অন্ধকার। একটাই প্রশ্ন, কোথায়? তারা কোথায়?
এই তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সাজিয়ে দিয়েছি অনেকের ইস্কুল ব্যাগ, জলের বোতল! জুতোর ফিতে ঠিকমতো বাঁধতে পারছে না দেখে একটু হেসে অনেকের জুতোর ফিতেও বেঁধে দিয়েছি। তারা কোথায় গেল? এই চিন্তাটা গুনগুন থেকে যখন ক্রমে ঝড়ের মতো হাজির হচ্ছে, তখনই স্কুল জানাল, না, আসেনি তো। যাদের নিয়ে সংশয়, তারা কেউ স্কুলেই আসেনি। হাজিরা খাতাও দেখাচ্ছে অনুপস্থিত! তা হলে?
মাথায় আকাশ ভেঙে-পড়া বোধহয় একেই বলে! |
|
দুর্গা চিত্রমালা থেকে নেওয়া ছবি। শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য |
স্কুলে আসেনি! তা হলে কোথায় গেল! এক জন-দু’জন হয়তো এ দিক ও দিক ছিটকে গিয়েছে, তা বলে এত জন! অনেক বাচ্চাও তো আছে, যারা একেবারে ছোট নয়, কিন্তু স্কুলের নাম করে বেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে, তেমনও নয়!
এই পর্যন্ত আতঙ্ক! বাকিটা এখন, গণমাধ্যমের সৌজন্যে, প্রায় ইতিহাস! কাগজে কাগজে বিপুল হেডলাইন! পড়ুয়াদের খোঁজ পাওয়া গেল। মিছিলে। সভায়। রাজনৈতিক সভায়। স্কুলে এসেই নাকি বেরিয়ে গিয়েছিল ম্যাটাডরে! সভা ভরাতে হবে যে! বুঝি বা না-বুঝি, হাততালি দিতে হবে, স্লোগান তুলতে হবে, গলা মেলাতে হবে বিভিন্ন কোরাসে!
অথচ, এখনও মনে পড়লে ঠান্ডা একটা আতঙ্ক শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যায়!
পড়ুয়ারা স্কুলে নেই! সেই মুহূর্তেই তোমার কথা মনে পড়ে।
তোমার দু’চোখের কথা।
না, দু’চোখ নয়, ত্রিনয়ন।
তার পর মনে মনে, প্রায় অস্ফুটেই বলা, তুমি জাগো!
সত্যি, খুব অসহায় সব মুহূর্তে সেই ত্রিনয়নের কথা মনে হয়। যেমন, সেই দমবন্ধ করা মুহূর্ত! আটকে আছি একটা অ্যাম্বুল্যান্স-এর ভিতরে। সামনে স্ট্রেচারে শায়িত এক জন, জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে ধূসর গোলকধাঁধার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছেন। এখনই যদি না পৌঁছে দেওয়া যায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, তা হলে হয়তো দ্রুত, খুব দ্রুত নিভে আসবে প্রাণশক্তি।
অথচ, রাস্তার গতি মন্থর, ক্রমে আরও মন্থর! কোথাও কোনও গাড়ি নড়ছে না। কী করে নড়বে? সভা চলছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। যদিও রাজপথের একটি ধারে, কিন্তু তার জন্য আটকে গিয়েছে অনেকখানি জায়গা! তার ওপর পুজোর মুখে সেই অঞ্চল জন-অরণ্য, রাস্তা উপচে ভিড় নেমে এসেছে রাস্তায়। সবাই খুঁজছেন নিজস্ব আনন্দের ঠিকানা! সুতরাং, রাস্তা জুড়ে পরপর গাড়ির মিছিল। ঠিক রুদ্ধসঙ্গীত-এর মতো। কারও কোনও গতি নেই। যদি বা কয়েক পা এগোয়, তার পরেই দীর্ঘ স্থবির দশা!
এ দিকে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে অবিশ্বাস্য দ্রুত! আওয়াজ করছে অ্যাম্বুল্যান্স!
গাড়ি এগোল! উৎকণ্ঠাকে খুব অবিশ্বাস্য একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়ে সেই রোগীকে শেষমেশ নিয়ে যাওয়া গেল হাসপাতালে। আই সি ইউ-তে। ফেরার পথে, তখন অন্তত আগের চেয়ে খানিক নিশ্চিন্ত, দেখা গেল একটা হোর্ডিং। সেখানে তুমি।
তোমার দু’চোখ!
না, দু’চোখ নয়, ত্রিনয়ন।
তার পর মনে মনে, প্রায় অস্ফুটেই বলা, তুমি জাগো! |
|
|
|
|
|