চিতলপেটি বা চিংড়ির মালাইকারি থাকলে সোনায় সোহাগা, নয়তো চোখ বুজে যে কোনও মাছ, খাসি প্যাক করান। আনারসের চাটনি এবং শুরুর মুড়োযোগে ডাল ও ছ্যাঁচড়াকে কিন্তু ভুলবেন না। রয়্যালের চাঁপের হাড় চুষতে ফেলুদার মগজের খিল খুলে যেত, গড়পড়তাদের জন্য এই ছ্যাঁচড়ার কাঁটাই কাফি। হাল্কা ঘিয়ের ছিটেয় বিয়েবাড়ি-সুলভ রাজসিক সোয়াদ। বেড়ালের মতো ধ্যানগম্ভীর ভঙ্গিতে কাঁটা চিবিয়ে পুরো পুজোর প্ল্যানটা ভেবে ফেলুন।
|
এনআরআই বন্ধুর মেমসাহেব বৌকে ‘ইম্প্রেস’ করতে পার্কের দ্য স্ট্রিটে নিয়ে যেতে পারেন। ডেকার্স লেনের মাংসের স্টু, কবেকার কলকাতার চঞ্চলার কুলফি থেকে শুরু করে ডিমের ডেভিল, ফুটপাথ-ছাপ পরোটা-চিলি চিকেন, মাংসের চপ, তেলেভাজার ফাইভ-স্টার অবতার। আসল কাশ্মীর না দেখে প্যান্ডেলের থিমের কাশ্মীর দেখে কি একটু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর গ্লানি হতে পারে? হলেও বা, কলেজ-বেলার পুরনো স্বাদের কথা ভেবে ম্নান হেসে বন্ধুর সঙ্গে রবি-দুপুরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে তাকিয়ে ‘চিয়ার্স’ করবেন। |
সন্ধেয় ঘুরে-টুরে ক্লান্ত হয়ে কোনও বিশ্বস্ত জায়গায় যাওয়াই ভাল। মার্কো পোলো ভাল পছন্দ! পুজোর অমানুষিক চাপেও যেখানে কোয়ালিটি টাল খায় না। ওদের নতুন মাটন কাবাব মাখন-নরম গালাওয়াত কি বোটি চাখা উচিত। দেশি-বিদেশি মিলিয়ে পছন্দমাফিক প্রন থার্মিডর কি কাশ্মীরি রোগান জোশ ‘কোহ-ই-আওয়াধ’ আদেশ করুন। স্প্যানিশ রসুন-চিংড়ির একটি বিশেষ পদ বা পেস্তো সসে চিকেন ও পেন পাস্তাও বার বার খেতে ইচ্ছে করে।
|
এই দুপুরটা ‘সিনিয়র সিটিজেন’-দের নিবেদন করা যাক। ইলিশ মাছ কি কাঁকড়ার ‘ঝুল কারি’-র লোভে মা-বাবা কি শ্বশুর-শাশুড়িদের সঙ্গে ‘দ্যাশে’ ঘুরে আসা যায়। হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনালের কলস-এ পঞ্চমী থেকে দশমী ছ’দিন দু’বেলা বাংলাদেশি বুফে। মশলাদার মেছো স্যালাড, নানা কিসিমের মাখো-মাখো ভর্তা ফরাসি টুকিটাকি বা অর্স্দভ (hors-d’oeuvre)-এর আদলে উপস্থাপিত। লাল শাক, বক ফুল ভাজা থেকে ঢাকাই মোরগ পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি বা রূপচাঁদা-আইর-চিতল-চিংড়ি কি কামিনি চাল-নলেন গুড়ের পায়েস কিছুরই অভাব নেই। ব্রেকিং নিউজ: মুরগি মানে এখানে পনিরপ্রতিম পানসে ব্রয়লার নয়, ফলতার দিশি মুরগি মজুত। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে সল্টলেক সিটি সেন্টারে আফরা। উনিশ শতকীয় ঘি-সুরভিত হাল্কা মিষ্টি চিকেন স্টেকের আমেজে গত পুজোয় ওরা ভরিয়ে দিয়েছিল। যা ফি-বছর একমাত্র শোভাবাজারে অ্যালেনের চিলতে ঠেকে মেলে। এ বারও বাঙালি কি কলোনিয়াল কিছু ‘টুইস্ট’ আফরায় থাকছেই। মোগলাই পরোটা ও ডিমের ভিন্দালু, বালিদ্বীপের শৈলীতে ভেটকিফ্রাই, লঙ্কাদ্বীপের ইলিশ ঘুরে-ফিরে ‘ষষ্ঠী টু দশমী’-বুফেয় আসবে। রাজযোটক ওয়াইনযোগে সি-ফুড কি ল্যাম্ব চপ-পর্ক চপের আপরুচি বিলাসও
স্মরণীয় হবে।
|
বাড়ির মতো ছোট ছোট ধবধবে লুচি দুনিয়ায় মিলবে না। রাজভোগেও একটু কুমড়োর ছক্কার বিরহে এ দুপুরে হৃদয় চঞ্চল হবে জানা কথা! তবে ওহ্ ক্যালকাটা-য় ঢুকলে কষ্ট কিছুটা পুষিয়ে যাবে। আকর্ষক বাঙালি বুফে তো পুজোয় ওরা দু’বেলা খাওয়াচ্ছেই, চাইলে ওদের মেনুর ক্লাসিক সৃষ্টিগুলো ঢুঁড়ে নেওয়া যায়। লঙ্কাভাপা মুরগি, ঢাকাই ফিশ টিক্কা বা ভদকা-জারিত মাতাল চিংড়ির মতো পদ চেহারায় গ্লোবাল হয়েও মশলার বিশিষ্টতায় খাঁটি বাঙালি। লুচি-কষা মাংস, চিতল মুইঠ্যা, মোচার ঘণ্ট নিশ্চয়ই আছে, তবে নেক্সট-লেভেল বাঙালি ফুড মুরগি মরিচ পোলাও, গন্ধরাজ ভেটকি বা ডাবের ভাপা সন্দেশ অদ্বিতীয়।
ডিনারে পার্কের স্যাফ্রন বা ব্রিজ। কানাডায় জলে হাত ডুবিয়ে ধরা মাংসল স্ক্যালপের মালাইকারি খেলে চিংড়িও মুখে লাগে না। হিমাচলের পুরুষ্টু ট্রাউট, নিউজিল্যান্ড ল্যাম্ব চপ কি দইয়ের তিরামিসুর মধ্যে বাছাই কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত। ভরা পেটে সন্ধিপুজো দেখতে গভীর রাতে শোভাবাজার রাজবাড়িতে যাওয়া যায়। চ্যাঙাড়ি-ভরা রকমারি নিমকি-গজা-দরবেশের প্রসাদী স্ন্যাক্স বিজয়ার পরে অতিথি-আপ্যায়নে কাজে লাগবে।
|
‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু
আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু!’
তাই দুপুরটা মেনল্যান্ড চায়না-র চেনা চিনে বুফে বা জনপ্রিয় বিরিয়ানির প্যাকেটে হাল্কা ভাবে কাটুক। পুজোর এই ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’ ঢুকুঢুকুটা গৃহকর্তা-কর্ত্রীর দায়িত্ব। বাকিটা ভাগাভাগি হবে। মুখ বদলাতে ট্যামারিন্ড থেকে কুর্গ উপত্যকার হাল্কা ধনেগন্ধী চিকেন কি মাটন আসুক কিংবা পুজো-স্পেশ্যাল হায়দরাবাদি উৎসবের কোনও কাবাব। চারকোল গ্রিল থেকে কাগজের মতো পাতলা নির দোসা, গার্লিক বাটার ক্র্যাব কি চিংড়ি-স্কুইড ঠাসা কোকোনাট রাইস! সল্টলেকের বন্ধুটি কে কে’জ ফিউশন-এর বাঙালি ক্রিশ্চান পর্ক সসেজ তুলে নিন। নর্থের আড্ডাধারীর দায়িত্ব, শেষপাতে নকুড়ের সন্দেশ কি মিত্র কাফের আশ্চর্য ছানার পুডিং।
|
লাঞ্চে বনেদি বাড়ির ভোগ থাকুক। বাঙাল-স্টাইলে ইলিশ চলতে পারে। ভাগ্যকুলের রায় পরিবার পুজোয় রোজই দু’বেলা ইলিশের ভাপা, বেগুন-কালোজিরের ঝোল, ইলিশের ডিম ভাপা খায়। দশমীর দুপুরে এই ইলিশ-যাপনে যতিচিহ্ন। এর পরে ফের সরস্বতী পুজোর জোড়া ইলিশ। এই কলকাতাতেও এ বাড়ির অনেক শরিক এমন নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। সন্ধেয় বড়দের প্রণাম করতে সঙ্গী বলরামের নলেন গুড় কি চন্দনী ক্ষীর ঠাসা মন্ডা। টুকটাকেই পেট জয়ঢাক। মায়ের হাতের হাল্কা আমচুর-ছড়ানো সিগনেচার পাঁঠার ঘুগনির বাটিটা সেই ছেলেবেলার মতোই অনার্য ভঙ্গিতে চেটে তকতকে করা হয়। আবার হবে তো আসছে বছর! তৃপ্ত আবেশে বিসর্জনের চিনচিনে বিষাদ হু-হু ছড়িয়ে পড়ে। |