|
পুজোর বেড়ানো... |
চলুন তবে মুখোশ-গ্রামে
প্রতি বাড়িতে প্রায় একই দৃশ্য। বাড়ির দালানে বসে পরিবারের
বড় থেকে ছোট, প্রায় সব সদস্যই ছো নাচের মুখোশ
তৈরিতে ব্যস্ত। দেখে এলেন কৌশিক ভৌমিক |
|
রবিবারের রাত পোহালেই আবার একরাশ মনখারাপ ঘিরে ধরে। সোমবার ব্যাজার মুখে অফিস যাত্রা। কিন্তু এই ব্যাজারত্বের ঘনত্ব কিছুটা কমে যায়, যদি উইকএন্ডে টুক করে একটা ট্যুর করে ফেলা যায়। বাজার যখন আগুন, তখন টুক করে ট্যুর বললেও একবারটি ঢোঁক গিলতে হয়। তবে এই আকালের দিনেও ছোটখাটো একটা বাজেট নিয়ে ঘুরে আসা যায় পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামে। এখানেই তৈরি হয় পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছো নাচের মুখোশ। শুধু তাই নয়, গ্রামটির ৯০ শতাংশ মানুষ ছো শিল্পী।
ট্রেনে বরাভূম স্টেশন। স্টেশনের কাছ থেকেই ট্রেকার পাওয়া যায় অযোধ্যার মোড় পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। ট্রেকারের ভাড়া যৎসামান্য। ট্রেকারে করে আসতে আসতে চোখ চলে যায় দু’পাশের শূন্য প্রান্তরের দিকে। শূন্য কিন্তু রুক্ষ নয়। অযোধ্যার মোড়ে ছোট একটা বসতি। এখান থেকে দু’পা দূরেই চড়িদা গ্রাম। দু’একটি থাকা-খাওয়ার হোটেল। |
|
চড়িদায় খুব কম ঘরই আছে যেখান থেকে এক জনও ছো শিল্পী ইউরোপ-আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যাননি। কিন্তু বিলেত-মার্কিন মুলুক থেকে পাওয়া সম্মান তাঁদের অভাব-অনটন ঘোচাতে পারেনি। প্রায় ৮০টি পরিবার নিয়ে এই গ্রাম। অধিকাংশ বাড়ি মাটির, খড়ের ছাউনি। প্রতি বাড়িতে প্রায় একই দৃশ্য। বাড়ির দালানে বসে পরিবারের বড় থেকে ছোট, প্রায় সব সদস্যই ছো নাচের মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত। কিন্তু সেই ব্যস্ততার মধ্যেও অচেনা মানুষের সব প্রশ্নের উত্তর দেন ধৈর্য ধরে। বলেন তাঁদের বারো মাসের জীবনযাপনের গল্প। অভাব-অনটনের মধ্যেও হাসিটা ঠিক ধরাথাকে তাঁদের মুখে। কথা বলতে বলতে ঘরের ভিতর উঁকি মারলেই দেখা যাবে দুর্গা থেকে গণেশ, শিব থেকে অসুর কত কিছুর মুখোশ। আকারও বিভিন্ন ধরনের। কিনতে চাইলে কিনেও ফেলতে পারেন মুখোশ।
পদ্মশ্রী খেতাব পাওয়া ছো শিল্পী গম্ভীর সিংহ মুড়ার নাম ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে আছে চড়িদার সঙ্গে। যাঁর হাত ধরেই ছো নাচ এ গ্রামকে এ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে নিয়ে গিয়েছে। শিল্পীদের মহড়া দেওয়ার জন্য গ্রামের মাঝখানে একটি ছোটখাটো হল আছে। গ্রামে ঢোকার মুখেই আছে গম্ভীর সিংহের একটি মূর্তি। |
|
বরাভূম থেকে চড়িদা আসার পুরো রাস্তা জুড়ে প্রচুর খেজুর গাছ। শীতের দিনে সকালে আপনার মন খেজুর রসের বায়না করলে তাও পাওয়া যাবে এই গ্রামের আলি ভাইয়ের ঘরে। অবশ্য আগে থেকে বলা থাকলে খাতির-যত্নের মিষ্টতা বহু গুণ বেড়ে যায়। আলি ভাইয়ের ঘরেই খেজুর রসে চুমুক দিতে দিতে বসে দেখা যাবে খেজুর গুড় বানানোর বিরল দৃশ্য। সঙ্গে পাত্র থাকলে বিশুদ্ধ নলেন গুড় কিনেও নিতে পারেন।
চড়িদার পিছনে পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গলের মধ্যে আর একটি সুন্দর জায়গা হদহদি ঝরনা। শীতকালে জল না থাকলেও বর্ষায় এর রূপ দেখার মতো। জঙ্গলের মধ্যে পথ জানা না থাকলে পথ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ওই পথে যাওয়ার আগে গ্রামের কাউকে সঙ্গী করে নেওয়াই ভাল। আর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গ্রামের মানুষদের উৎসাহ প্রবল। শাল, বয়রা, আমলকীর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে এই ঝরনার জায়গাটি বেশ মনোরম। |
|
শীতকালে অনেকেই পিকনিক করতে এখানে আসেন। হদহদিতে গিয়ে জল দেখতে না পেলেও চুপ করে বসে থাকলে নানা ধরনের পাখির ডাক মন ভরিয়ে দেবে। হঠাৎ করে টুসু গান কানে ভেসে আসতে পারে। কখনও দেখা যায় দল বেঁধে গ্রামের মেয়ে-বৌরা কাঠ কাটতে, পাতা কুড়োতে জঙ্গলে যাচ্ছেন। সবার গলায় একই সুর।
সমতল থেকে ৭০০ মিটার উচ্চতায় অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গলের রাস্তা বেয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় থুর্গা লেকে। বৃষ্টির জলই এই লেকটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বর্ষায় এর রূপ অনন্য। এই লেক থেকে কিছু দূরে বাঘমুন্ডি গ্রাম। অযোধ্যা ও বাঘমুন্ডির জলের একমাত্র উৎস থুর্গা লেক। বিশাল লেকের ঠান্ডা হাওয়া মন জুড়িয়ে দেয়। |
|
থুর্গা যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়বে মানভূম ট্যুরিস্ট লজ। একদম নির্জন প্রকৃতির মধ্যে যাঁরা থাকতে চান, তাঁদের জন্য মানভূম ট্যুরিস্ট লজ আদর্শ। এখানকার কেয়ারটেকারকে বললে খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
অযোধ্যার মোড় থেকে কিছু দূরেই আছে পাখিপাহাড়। ট্রেকিং-এর উপযুক্ত জায়গা। পাখিপাহাড় নামটা অবশ্য অন্য কারণে। কিছু চিত্রশিল্পী মিলে বিশাল বিশাল পাখির ছবি এঁকে রেখেছেন পাহাড় জুড়ে।
প্রকৃতি, ঐতিহ্য, সব কিছু মিলেমিশে একাকার চড়িদায়। |
|