রাজ্য সরকারের তরফে একটা অভিনন্দন বার্তা যায়নি। কেউ হয়তো জানেনই না খবরটার তাৎপর্য।
শিলিগুড়ির শালবাড়িতে এক দম্পতির উপচে পড়া গর্বের সঙ্গী হতে পারে পুরো বাংলা। বাড়ির কর্ত্রী পার্বতী ছেত্রী ফোন ধরে সরল অকপট, “দুর্গা মা’র কাছে প্রার্থনা করব, আমার ছেলে যাতে ভাল খেলে। ভারত দারুণ কিছু করে।”
পুজোয় বাংলার খেলার সেরা খবর।
কালিম্পংয়ের ‘সিক্সটিন মাইলস’ এলাকায় বেড়ে ওঠা এক তরুণই এখন জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক। ভরত ছেত্রী। বেঙ্গালুরুতে জাতীয় শিবিরে ব্যস্ত। প্র্যাক্টিস সেরে ফোনে ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি মিশিয়ে ভরত বললেন, “আমার ভাল লাগছে, বাংলা থেকে অনেক দিন পরে কেউ জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক হল বলে। জানেন তো, আমার মা ও বোন খুব ভাল বাংলা জানে! আমি বাংলা সব বুঝতে পারি। ভাল বলতে পারি না।”
কালিম্পংয়ের সিক্সটিন মাইলস অঞ্চল থেকে জাতীয় হকি দলের অধিনায়কের পদে উত্তরণ, কী করে সম্ভব হল? ভরত যা বলে যাচ্ছিলেন, তা শুনলে প্রথমে অনেকে বিশ্বাস করবেন না। “ক্লাস এইট পর্যন্ত ফুটবল খেলতাম কালিম্পংয়ে। আমাদের ওখানে তো কোনও হকি মাঠ নেই। সেন্ট জর্জ হাউস স্কুলের হয়ে ফুটবল খেলেছি। পটনা থেকে একদিন তুতোভাই প্রেম সিংহ রানা এল। ও-ই হকি নিয়ে আগ্রহ তৈরি করে দিল। আমি পটনায় চলে গেছিলাম। প্রেমের কাছেই হকি শেখা।”
একশো ষাটের কাছাকাছি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে ভারতীয় সিনিয়র দলের হয়ে। পটনা থেকে বেঙ্গালুরু। আর্মি দল থেকে কানাড়া ব্যাঙ্কের চাকরি। আশিস বল্লালের ভক্ত ভরতের কথায়, “আশা করছি, অস্ট্রেলিয়া সফরে আমাদের টিম ভাল খেলবে। কোচ মাইকেল নবস আমায় বুধবার রাতে বলেছিলেন, ক্যাপ্টেন হওয়ার কথা। মিথ্যা বলব না, একটু অবাক হয়েছিলাম। কর্নাটক রাজ্য দলের অধিনায়কত্ব করেছি। কিন্তু ভারতীয় দলের নেতৃত্ব...!”
জাতীয় হকি অধিনায়ককে রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যতই উপেক্ষা করুক, তাঁর মোবাইলের ইনবক্স মেসেজ উপচে পড়ছে শুভেচ্ছা বার্তায়। সব কালিম্পং থেকে। তাঁর মতো তাঁর মা পার্বতী, বাবা কর্ণবাহাদুর সবারই জন্ম ওই অঞ্চলে। “আমি কালিম্পংকে খুব মিস করি। বাড়িটা। স্কুল। খেলার মাঠ। সব বন্ধুরা। সবাই কাল থেকে মেসেজ আর ফোন করে যাচ্ছে,” ভরতের গলায় চাপা উচ্ছ্বাস ও স্মৃতিমেদুরতা। “আমার বাবা-মা তিন বছর হল শিলিগুড়িতে চলে এসেছেন। আমার মার্চের পরে যাওয়া হয়নি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে যাব।”
বাংলার শেষতম জাতীয় হকি অধিনায়ক বলজিৎ সিংহ সাহনি এখন জাতীয় দলের সহকারী কোচ। তবে তাঁর অন্য কাজ। শিবিরে নেই। ভরত মজে রয়েছেন শিবিরে। কমনওয়েলথ গেমসে ভারত-পাক ম্যাচের নায়ক বলছিলেন, “অস্ট্রেলিয়াতেও রয়েছে ভারত-পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। সেটা মাথায় রয়েছে আমার। নবস খুব ভাল কোচ। উনি এসে পুরনো স্টাইলে আমাদের আক্রমণাত্মক খেলাচ্ছেন। ওটাই খেলব। উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলাচ্ছেন সবাইকে। ক’দিন আগে চিনে পাকিস্তান ম্যাচটা যেমন আমায় খেলাননি।” কমনওয়েলথ গেমসের ওই ভারত-পাকই তাঁর এখন পর্যন্ত সেরা ম্যাচ মনে করেন ভরত। “তার পরে চেন্নাই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জার্মানি আর অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ। এশিয়ান গেমসে কোরিয়া ম্যাচ। আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট জুনিয়র এশিয়া কাপে খেলার সুযোগ পাওয়া।”
ভরত ছেত্রী যখন বেঙ্গালুরু শিবিরে ব্যস্ত, তখন শুক্রবার রাতে আর এক ছেত্রী কলকাতা থেকে রকেট বাসে পুজোর ছুটিতে যাচ্ছেন কালিম্পংয়ে। বীরবাহাদুর ছেত্রীভারতের শেষ অলিম্পিক সোনা জয়ী হকি দলের গোলকিপার। কালিম্পংয়ের বোমবস্তিতে বাড়ি তাঁর। ভরত বলছিলেন, “ওঁর সঙ্গে ফোনেই কথা হয়েছে কয়েক বার। সামনাসামনি দেখা হয়নি।” বীরবাহাদুর অভিভূত, “কালিম্পংয়ে আমারও জন্ম। ওখান থেকে দু’জন ভারতীয় হকি গোলকিপার, ভাবাই যাচ্ছে না। মাঠ নেই। হকি খেলা নেই। আমি এসেছিলাম কলকাতা পুলিশের হয়ে ফুটবল খেলতে। তার পরে এক দিন হকিতে চলে এলাম।” নতুন হকি অধিনায়ক ভরতের পরের কথাটা মনে পড়ল, “আমি হকি ছাড়া শুধু ফুটবল দেখি। হকি প্লেয়ার বাদে আমার ফেভারিট হল ভাইচুং ভুটিয়া, সুনীল ছেত্রী, সুব্রত পাল।” তিনিও ফুটবল পাগল।
এখানেই দুঃখ উপচে পড়ছে নতুন ভারত অধিনায়কের। “কালিম্পংয়ে অনেক ছেলে হকি খেলতে চায়। ভাল কোচিং চায়। হকি মাঠ নেই। যদি কিছু হত।” ভরতের কথা শুনে লুফে নেন বীরবাহাদুর ছেত্রী, “অ্যাস্ট্রোটার্ফ দরকার নেই। কলকাতাতেই সেটা হয়নি। এখন কালিম্পংয়ে ঘাসের মাঠই করে দেওয়া হোক। অনেক প্লেয়ার বেরোবে।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কি পৌঁছবে কালিম্পংয়ের আর্তি? |