তামিলনাড়ুর ধর্মপুরী জেলার ভাচাথি গ্রামে উনিশ বছর আগে রাজ্যের বন দফতর, রাজস্ব দফতর ও পুলিশের ২৬৯ জন অফিসার ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে তিন দিন ধরিয়া লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ ও গণধর্ষণের যে নারকীয় লীলার অভিযোগ ছিল, এত দিনে তাহার বিচার হইয়াছে। অভিযোগ অনুসারে, অত্যাচারীদের লক্ষ্য ছিল চন্দন কাঠের চোরাচালান মসৃণ ও অবাধ করিতে প্রতিবাদী দলিত ও জনজাতীয় গ্রামবাসীদের এমন শিক্ষা দেওয়া, যাহাতে তাহারা উদ্বাস্তু হইয়া যায় এবং লক্ষ্য সাধনে ১৮ জন দলিত ও আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণও করা হয়, যাহাদের মধ্যে ১৩ বছরের বালিকারাও ছিল। সে সময় তামিলনাড়ুর শাসনক্ষমতায় ছিলেন আজকের জয়রাম জয়ললিতাই। কিন্তু দলিত মহিলাদের উপর নির্যাতন হয়তো এই ব্রাহ্মণতনয়াকে দ্রবীভূত করিতে পারে নাই। পেরিয়ার ও আন্নাদুরাইয়ের ঐতিহ্যের বৈধ উত্তরাধিকার লইয়া ডি এম কে-র সহিত তুমুল দ্বন্দ্বে লিপ্ত জয়ললিতার সরকার সে সময় যে আচরণ করে, তাহাতে অভিযোগ ওঠে যে, তাহারা গোটা ঘটনাটিকে ধামা-চাপা দিতে চাহে। অন্যতম বিরোধী দল সি পি আই এমের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত ঘটনাটির সি বি আই তদন্ত শুরু হয়। আর তাহাতেই নানা তথ্য প্রকাশ হইতে থাকে।
দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজ্যে বহুমূল্য চন্দন কাঠের চোরাচালান একটি সংগঠিত অপরাধ। সেই অপরাধ চক্রের পাণ্ডারা বন দফতর, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের অফিসার-কর্মীদের একাংশের সহিত ঘনিষ্ঠ যোগসাজশ রক্ষা করিয়া চলে, এমন অভিযোগ বহুশ্রুত। যাহাদের কাজ অরণ্য ও তাহার সম্পদ রক্ষা করা, তাহারাই যদি ভক্ষক হইয়া ওঠে, তবেই চোরাচালান সফল হইতে পারে। চন্দনদস্যু বীরাপ্পনও যে দীর্ঘ কাল কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর গভীর অরণ্যে আপন সাম্রাজ্য চালাইতে পারিয়াছিল, তাহাও এই সরকারি রক্ষকদের সৌজন্যেই। ভাচাথি গ্রামের ক্ষেত্রে চন্দন-কাঠ মাফিয়ারা নিজেরা কোনও ত্রাস সৃষ্টিতে লিপ্ত হয় নাই, তাহাদের হইয়া বন বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ ও পুলিশই হাতে-কলমে অপকর্মটি করিয়া দেখায়। একটি দলিত জনপদে লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ ও গণধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত ২৬৯ জনের সকলেই সরকারি কর্মচারী, এমন নজিরও কি ভারতের অপরাধ-ভুবনের ইতিহাসে একটিও আছে? ১২৬ জন বনরক্ষী, ৮৪ জন পুলিশ এবং ৫ জন রাজস্ব কর্মী মিলিয়া এমন একটি অপকাণ্ড করিল, অথচ উনিশ বছর ধরিয়া তাহাদের কোনও শাস্তি হইল না? বনরক্ষীদের মধ্যে পাঁচ জন ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের অফিসার, পুলিশের মধ্যে দুই জন ইনস্পেক্টর ও ছয় জন সাব-ইনস্পেক্টর, আর রাজস্ব কর্মচারীদের মধ্যে দুইজন তহসিলদার। অর্থাৎ পদস্থ, দায়িত্বশীল সরকারি অফিসাররা পর্যন্ত বিভাগীয় কর্মীদের নিবৃত্ত করার পরিবর্তে তাহাদের সঙ্গে মিলিয়া তিন দিনের এই মাৎস্যন্যায়ে মাতিয়াছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এমন অপকাণ্ডের প্রায়শ্চিত্ত রাষ্ট্র কেমন করিয়া করিবে? এই সব ঘটনা দেখাইয়া দেয়, দলিত-আদিবাসীরা এখনও দেশে অবমানবের মতোই বাঁচিয়া থাকে। কোনও কোনও রাজ্যে দলিত মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতাসীন হইলেও তাহা বৃহত্তর দলিত সমাজের ক্ষমতায়ন ঘটায় নাই, নেতা বা নেত্রীর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করিয়াছে মাত্র। তাই উত্তরপ্রদেশেও দলিতকন্যারা নিয়মিত উচ্চবর্ণীয় ক্ষমতাশালীদের দ্বারা ধর্ষিত হইয়া থাকেন, এমনকী বহুজনসমাজ পার্টির নির্বাচিত অ-দলিত জনপ্রতিনিধিরাও এই অপকর্মে লিপ্ত হইয়া পার পাইয়া যান, যতক্ষণ না আদালত হস্তক্ষেপ করে। তামিলনাড়ুতেও আদালতের হস্তক্ষেপেই নিপীড়ক ও ধর্ষকরা দণ্ডিত হইয়াছে। অসহায় মানুষদের নিপীড়নের প্রতিকার চাহিয়া রাজনৈতিক দলের আন্দোলন, উদাসীন সরকারের নিজস্ব পুলিশের কাছ হইতে নিরপেক্ষ তদন্তের ভার সি বি আইয়ের হাতে অন্তরিত করিতে বাধ্য করা, আদালতে বিচারান্তে দোষীদের শাস্তিবিধান এই গোটা প্রক্রিয়াটিই গণতন্ত্রের তথা আইনের শাসনের উপর অবহেলিত, নিঃসহায় মানুষদের আস্থা ফিরাইয়া আনিতে পারে। তবে প্রক্রিয়াটি বেশি দীর্ঘ হইয়া গিয়াছে। এতই দীর্ঘ যে, অভিযুক্তদের মধ্যে ৫৪ জন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ও শাস্তি পাওয়ার আগেই মারা গিয়াছে। ভবিষ্যতে তাই এ ধরনের নারকীয় নৃশংসতার পত্রপাঠ প্রতিবিধান হওয়া দরকার। |