চেষ্টা করেছিলেন বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী। চেষ্টা করেছিলেন আরও অনেকেই। কিন্তু দিল্লিতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে প্রথম দিনে অন্তত এলেনই না গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর মোদীকে ঘিরে বিতর্কের ধাক্কাতেই বিজেপির অভ্যন্তরে বাজপেয়ী-আডবাণী ‘জমানা’র অবসান ঘটানোর যে চেষ্টা সঙ্ঘ পরিবার চালাচ্ছিল, তা কার্যত মাঠে মারা গেল। বিজেপির অভ্যন্তরে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হল।
দিল্লিতে দলের এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আসেননি কর্নাটক ও উত্তরাখণ্ডে সদ্য মুখ্যমন্ত্রী পদ খোয়ানো দুই নেতা ইয়েদুরাপ্পা এবং রমেশচন্দ্র পোখরিয়ালও। কিন্তু তাঁদের নিয়ে তত বিতর্ক বাধেনি। জাতীয় কর্মসমিতির এ বারের বৈঠকের উদ্দেশ্যই ছিল, দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়ে মনমোহন সিংহের সরকারকে চার দিক থেকে ঘিরে আক্রমণের কৌশল নেওয়া। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে দলের মধ্যের লড়াই বন্ধ করা। কিন্তু তা হল কই? সব ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠল লালকৃষ্ণ আডবাণী বনাম নরেন্দ্র মোদী লড়াই। প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে কে এগিয়ে, তা নিয়ে বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই মুখ খুললেন। বিতর্ক উস্কে গডকড়ী আবার আডবাণীর প্রশংসা করার পাশাপাশি বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ঘোরতর মোদী-বিরোধী সঞ্জয় জোশীকে। তিনি অবশ্য উমা ভারতীকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সঞ্জয় জোশী সন্ধ্যার পরে কর্মসমিতির বৈঠকে যোগ দিতে আসেন। তাঁকে মোদী-বিরোধীরা বিপুল অভিনন্দন জানান, যা নিঃসন্দেহে মোদীর পক্ষে অস্বস্তিকর। |
আজ বৈঠকের শুরুতেই আডবাণী ও মোদী সমর্থকদের মধ্যে এক রকম বাগযুদ্ধ বেধে যায়। শত্রুঘ্ন সিন্হা প্রকাশ্যেই আডবাণীর হয়ে সওয়াল করেন। পাল্টা জবাবে বলবীর পুঞ্জ বা পুরুষোত্তম রূপালা বলেন, “সুযোগ পেলে মোদীই সব থেকে ভাল প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।” দিনের শেষে অবশ্য মোদী অনেকটাই কোণঠাসা। বিনয় কাটিয়ার তো খানিকটা কটাক্ষের সুরেই বলেছেন, “এখনও গুজরাতেই আরও অনেক সাফল্য পেতে হবে মোদীকে। আগে সে কাজ শেষ করুন তিনি। তার পরে প্রধানমন্ত্রিত্বের বিষয়টি ভাবা যাবে।”
বিনয় কাটিয়ারের সুর শোনা গিয়েছে আরও অনেকের গলায়। বিজেপি শাসিত অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও ঘনিষ্ঠ মহলে মোদীর সমালোচনা করেছেন। নবরাত্রির উপবাসের জন্য মোদী বৈঠকে আসবেন না বলে জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গ টেনে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান জানান, নবরাত্রির উপবাস সত্ত্বেও তিনি কিন্তু এসেছেন। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, “অনেক ক্ষোভ থাকলেও লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো কোনও শীর্ষ নেতাকে দেখা যায়নি কোনও বৈঠকে গরহাজির থাকতে। যে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁর এমন আচরণ? এখন থেকেই এত অহং বোধ? এ সব তাঁর ক্ষেত্রে হিতে বিপরীতই হবে। যাঁরা আজ এলেন না, তাঁরা শুধু খবরে এলেন!” আর এক নেতার কথায়, “মোদী নিজেকে দলের উপরে ভাবতে শুরু করেছেন!”
সঙ্ঘ নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই আডবাণীকে প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড় থেকে বাদ রেখেছেন। অনশনের সময় মোদীকেই সমর্থন করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু মোদীর না আসাকে ঘিরে যে ভাবে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের অভিমুখই বদলে গিয়েছে, তাতে মোটেই খুশি নন তাঁরা। এই অবস্থায় মোদী যাতে আগামিকাল অন্তত কর্মসমিতির বৈঠকে যোগ দেন, সে চেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু সঞ্জয় জোশীকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর ‘রাগ’ বাড়িয়ে দিয়েছেন গডকড়ী নিজেই। গডকড়ী শিবিরের অবশ্য যুক্তি, সঞ্জয় জোশীকে তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার জন্যই উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে আনা হয়েছে। গুজরাতের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কই নেই। মোদীর আপত্তির জন্য উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপির অবস্থা খারাপ করে কোনও লাভ নেই।
মোদী শিবিরের এক নেতা বলেন, “শুধু সঞ্জয় জোশীর ব্যাপারটাই নয়। মোদীর অনশন বয়কট করেছিলেন নীতীশ কুমার। গডকড়ী সেই নীতীশকেই ফোন করে বিহার থেকে শুরু হওয়া আডবাণীর রথযাত্রা সফল করার চেষ্টায় উদ্যোগী হলেন। কী বার্তা দিতে চাইলেন গডকড়ী?” ওই নেতার বক্তব্য, সঙ্ঘ সমর্থন করলেও মোদীর অনশন মঞ্চে বিজেপির কোনও শীর্ষ নেতা তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে বলেননি। তার উপর অনশন শেষ হওয়ার পর দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মোদী যদি না আসেন, তা অযৌক্তিক বলা যায় না।”
বিজেপির অভ্যন্তরীণ বিরোধকে উস্কে দিতে কংগ্রেসও আজ ময়দানে নেমেছে। ঘটনাচক্রে আজই গ্রেফতার করা হয়েছে মোদী-বিরোধী পুলিশ কর্তা সঞ্জীব ভট্টকে। গুজরাত দাঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি মোদীর সমালোচনা করেছিলেন। কংগ্রেস সেই প্রসঙ্গও টানছে। দলের মুখপাত্র রেণুকা চৌধুরি বলেন, “দেশের সমস্যা বা সাধারণ মানুষ কাউকে নিয়েই বিজেপির মাথাব্যাথা নেই। শুধু কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়েই সারা বছর লড়াই করে গেল! যে নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি মাথায় তুলে নাচছে, তিনিই সঞ্জীব ভট্টকে গ্রেফতার করছেন! গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে মুখ খুললে মোদী যে প্রতিহিংসার পরিচয় দেন, তা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।”
দিনের শেষে বিজেপি পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামে। দলের মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ জানান, “বিশৃঙ্খল অফিসারকে গ্রেফতার করে সঠিক কাজই করেছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি যোগ্য মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যও তিনি যোগ্য। কিন্তু কোন সময়ে কে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হবেন, তা উপযুক্ত সময়েই ঘোষণা করা হবে।” |