|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা |
সম্প্রতি গ্যাঞ্জেজ আর্ট গ্যালারিতে মৃণাল মণ্ডলের প্রদর্শনী দেখলেন মৃণাল ঘোষ। |
সমকালের বা একেবারে সাম্প্রতিক কোনও ঘটনাকে নিয়ে শিল্প গড়ে তোলা কঠিন। তা ‘প্রচার’ হয়ে যেতে পারে। ইলাস্ট্রেশন বা সচিত্রকরণ হয়ে যেতে পারে। চিরন্তনের নান্দনিকতা ব্যাহত হতে পারে তাতে। তবু অনেক শিল্পী এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন এবং সফলও হন। বিশ্বশিল্পে এর দৃষ্টান্ত কম নেই। সমস্ত রকম অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া শিল্পীরও একটা দায়। সেই দায়বোধ থেকেই তরুণ শিল্পী মৃণাল মণ্ডল সম্প্রতি ‘রুটস’ শিরোনামে ইনস্টলেশন ও ভিডিও-র প্রদর্শনী করলেন গ্যাঞ্জেজ আর্ট গ্যালারিতে।
কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রাপ্ত এই শিল্পী নিসর্গ নিয়ে নিমগ্ন ভাবে কাজ করে আসছেন অনেক দিন থেকে। প্রকৃতির প্রতি তাঁর ভালবাসা অকৃত্রিম। সেখান থেকে তিনি যখন দেখেন ভোগবাদী সভ্যতার অগ্রগতির দাপটে বিশ্ব জুড়ে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, প্রকৃতিসংলগ্ন মানুষ বিপর্যস্ত হচ্ছে, তখন তাঁর ভিতর প্রতিবাদ জাগা স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এই সাধারণ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন একেবারে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ঘটে যাওয়া বা এখনও ঘটতে থাকা কিছু ঘটনাকে। ঝাড়গ্রামে তাঁর জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা। সেখানকার প্রকৃতির সঙ্গে শৈশব থেকে তাঁর একাত্মতা। সেই প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত হতে দেখছেন বেশ কিছু দিন থেকে। কাছেই জঙ্গলমহল। রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও পাল্টা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে সেখানে প্রকৃতি ও মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন এই কাজগুলি। চারটি ইনস্টলেশন ও একটি ভিডিও। ‘দিস ইজ মাই হোম টু’ শীর্ষক ভাস্কর্যধর্মী ইনস্টলেশনটিতে তিনি পেপার পাল্প দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই উইয়ের ঢিবি। জঙ্গলমহলেই জঙ্গলের ভিতর একটি প্রকৃত উই ঢিবি থেকে ছাপ তুলেছেন। তাই খুব সুন্দর টেক্সচার বা বুনোট এসেছে। সেই উঁই ঢিবির দিকে ধাবিত হচ্ছে অজস্র ধাতুতে তৈরি পিঁপড়ে। রচনাটি প্রতীকী। শিরোনাম থেকে মনে হয় শিল্পী হয়তো বোঝাতে চাইছেন কেমন করে কোনও প্রাণীর (বা মানুষের) আবাসস্থল অন্যের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। অথবা আশ্রয়হারা অনাবাসী মানুষ নতুন আশ্রয় সন্ধান করে। ভাস্কর্য হিসেবে এই রচনাটির নান্দনিক সংহতি প্রশংসনীয়। |
|
শিল্পী: মৃণাল মণ্ডল |
দ্বিতীয় রচনাটির শিরোনাম ‘ভীষ্মের গাছ’। পেপার পাল্পে তৈরি করা হয়েছে ভেঙে পড়া একটি বড় গাছের প্রতিরূপ। মেঝের উপর একটি পেডেস্টালে রাখা হয়েছে সেটি। সংলগ্ন মেঝের উপর সাঁটা রয়েছে কিছু লেখামালা। জঙ্গলমহলের মানুষকে শিল্পী প্রশ্ন করেছিলেন ওখানকার বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে। তাঁদের দেওয়া উত্তরগুলি এভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভূপতিত বৃক্ষের তলায়। সাধারণ প্রাকৃতিক ধ্বংসকে এভাবে যুক্ত করা হল একটি বিশেষ অঞ্চলের বাস্তবতার সঙ্গে। এখানে সমস্যা হচ্ছে নির্বিশেষকে যে বিশেষের সঙ্গে যুক্ত করা হল, সেটা বলে না দিলে বুঝে ওঠা কষ্টকর। সেজন্যই রচনাটিকে একটু আরোপিত মনে হয়। ভীষ্মের পুরাণকল্পের সঙ্গে যুক্ত করাটাও যেন একটু কষ্টকল্পিত।
তৃতীয় রচনাটির শিরোনাম ‘নাইটমেয়ারস’। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে প্রখ্যাত লোকচিত্রী স্বর্ণ চিত্রকরের আঁকা চারটি প্যানেল। পেছনের দুটিতে রয়েছে মহাভারতের জতুগৃহদাহ ও চক্রব্যূহে অভিমন্যু হত্যার পুরাণকল্প। সামনের দুটি প্যানেলে রয়েছে জঙ্গলমহলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিও ট্রেন ধ্বংসের আলেখ্য। মাঝখানে ছড়ানো শুকনো ঝরা পাতা আর তার মাঝখানে একটি মৃত পশুর করোটি। এই ধরনের প্রতীকী এবং বিশেষ ও নির্বিশেষের সুষম সমন্বয়ে গড়ে তোলা সফল কাজের দৃষ্টান্ত। সন্ত্রাস ও প্রতিরোধী সন্ত্রাস এই দুইয়ের মাঝখানে পিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষের যে হাহাকার সেটাই যেন ধ্বনিত হচ্ছে এখানে।
চতুর্থ রচনাটি ‘ভায়োলেটেড’। কয়েক জন সাধারণ মানুষের মুখের ভাস্কর্য। উপর থেকে সেই মাথার দিকে ধাবমান হয়েছে অজস্র তির। এই রচনাটি দুর্বল। এর প্রতীকী ব্যঞ্জনাও নান্দনিক ব্যাপ্তি পায়নি।
এর উল্টো দিকের দেয়ালে ‘ফায়ার’ ভিডিওটি। সবুজ, জীবন্ত বন ছিল এক সময়। আজ সেখানে বৃক্ষরাজি ধূসর, বর্ণহীন হয়ে গেছে। মানুষ গৃহহারা, জীবিকাহারা। সন্ত্রাসের ভয়ে আড়ষ্ট। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই মানুষদের জীবনও। এর কোনও প্রতিকার নেই। এই বিপর্যয়কে মৃণাল তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘ দিন থেকে পরিশ্রম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, সাম্প্রতিকের ঘটনাবলি তাকে যে ভাবে ব্যথিত করেছে তারই প্রতিক্রিয়ায়। তাঁর এই প্রয়াসের মধ্যেই রয়েছে মহৎ চেতনার বীজ। |
|
|
|
|
|