আলেকজান্দারের দেশও এখন সাহায্য চায় পুরুর দেশের কাছে!
সৌজন্য, ইউরোপের দেশগুলির ভয়ঙ্কর আর্থিক সঙ্কট।
ঋণের ভারে এতই জর্জরিত গ্রিস যে, ইউরোপের প্রতিবেশী ও চিরাচরিত বন্ধু দেশগুলির কাছ থেকেও সহায়তা পাওয়া শক্ত হয়ে পড়ছে। ফ্রান্স-জার্মানি-আমেরিকায় ভোট আগামী বছর। ক্ষমতাধর এই দেশগুলিও ঘরোয়া রাজনীতির চাপে গ্রিস বা ইউরোপের অন্য দুঃস্থদের জন্য এই মুহূর্তে সে ভাবে হাত উপুর করতে করতে আগ্রহী নয়। এমনকী, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক কিছুটা সাহায্যের চেষ্টা চালালেও বাদ সাধছে জার্মানি। এ-হেন অবস্থায় প্রাচ্যই ভরসা গ্রিসের। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সে কথাই জানিয়েছেন গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ইভানজিলোস ভেনিজেলোস। তাঁর বক্তব্য, ভারতের সঙ্গে গ্রিসের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিগত যোগাযোগ বহু প্রাচীন। আজ এই বিপদের দিনে ভারত তাই পাশে দাঁড়াবে, এমনটাই আশা করছেন গ্রিসের নেতৃত্ব।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, প্রণববাবু তাঁকে জানিয়েছেন, গ্রিস তথা ইউরো সঙ্কটে ভারতও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কেন-না এই বিশ্বায়নের যুগে কেউই আর পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়েছে। আর্থিক মন্দা দ্রুত সংক্রামিত হচ্ছে দেশ থেকে দেশে। ইউরো জোনের ১৭টি দেশেই জিনিসপত্রের দাম এত দ্রুত বাড়ছে, যে গত তিন বছরের মধ্যে এমনটা দেখা যায়নি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আর্থিক মন্দা। শেয়ার বাজারের মুখ নিচের দিকে। তবে এই রকম সঙ্কটের মধ্যেও গ্রিসে যে রাজনৈতিক সুস্থিতি রয়েছে, এটাই আশার কথা বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। শুধু তাই নয়, ঋণে জর্জরিত হয়েও গ্রিসের সরকার কর ও অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কারের পথে এগোচ্ছে। গত জুলাই মাসে আস্থা ভোটে জিতে এর জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থনও আদায় করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রেউ। একান্ত বৈঠকে গ্রিসের অর্থমন্ত্রীকে প্রণববাবু জানিয়েছেন, বিপদের মধ্যেও সংস্কারের কাজে সংসদের সমর্থন আদায় করে নেওয়াটা পাপান্দ্রেউয়ের একটি ‘মাস্টার স্ট্রোক’ বলেই মনে করেন তিনি। কারণ, এর ফলে তিনি নির্ভয়ে সংস্কারের পথে এগোতে পারবেন। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিধর দেশগুলি যাতে গ্রিস, পর্তুগাল বা আর্য়াল্যান্ডের মতো রুগ্ণ দেশের পাশে দাঁড়ায় সে ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন বলে ইভানজিলোসকে আশ্বাস দিয়েছেন প্রণববাবু। আগামী মাসে প্যারিসে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন। ভারতের অর্থমন্ত্রী সেখানে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই উত্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন।
প্রণববাবু ভাল করেই জানেন, এ কাজে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা আসবে ফ্রান্স এবং জার্মানির পক্ষ থেকে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে নয়, এই বিরোধিতার অনেকটা রাজনৈতিক। অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “আগামী বছরই জার্মানি, ফ্রান্স এবং আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই অবস্থায় ইউরো জোনের ঋণগ্রস্ত দেশগুলির সাহায্যার্থে কিছু করতে গেলে ঘরোয়া রাজনীতিতে চাপ আসবে। ঝুঁকিপূর্ণ কোনও বিদেশি বন্ড কিনে এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা হারাতে চাইছে না ক্ষমতাসীন কোনও দল। এই কারণেই সার্বিক ভাবে ইউরোপের দেশগুলির সঙ্কটমুক্তির লক্ষ্যে কোনও শক্তিশালী পদক্ষেপ করার ব্যাপারে এক মত হতে পারছে না জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি।”
সমস্যা হল ইউরোপের সঙ্কটগ্রস্ত দেশগুলিকে অর্থনৈতিক ভাবে চাঙ্গা করার বাড়তি দায়িত্ব নিতে হচ্ছে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ককে (ইসিবি)। কিন্তু সেটাও তারা কত দিন চালিয়ে যেতে পারবে তা অনিশ্চিত। স্পেন বা ইতালির মত দুঃস্থ দেশগুলির সরকারি বন্ড কিনছে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে এই ব্যাঙ্কের মধ্যে স্ববিরোধ ক্রমশই প্রকাশ্যে চলে আসছে। ইসিবি-র সবচেয়ে শক্তিধর প্রতিনিধি জার্মানি এই দেশগুলির বন্ড কেনার ঘোরতর বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে। প্রতিবাদে জার্মানির দুই ব্যাঙ্ক কর্তা ইতিমধ্যে ইস্তফাও দিয়েছেন। গ্রিসের ঋণ শোধ করার সম্ভাবনা যত কমে আসছে ইসিবি-র উপর চাপ ততই বাড়ছে। এর ফলে স্পেন বা ইতালির মতো দেশকে সঙ্কটমুক্ত করার সম্ভাবনাও ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।
এই অবস্থায়, চিনকে আরও সক্রিয় হওয়ার জন্য আগামী দিনে চাপ বাড়াতে চায় ভারত। যদিও তাতে কাজের কাজ কতটা হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে দিল্লির। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে ব্রিকস (ব্রাজিল রাশিয়া, ভারত, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)-র অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে চিনকে অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে তারা গ্রিস, ইতালি, পর্তুগালের মতো দেশগুলিকে আর্থিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। ভবিষ্যতে আবারও এই অনুরোধ করা হবে। যদিও অর্থ মন্ত্রকের কর্থার কথায়, “বেজিং আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে মৌখিক ভাবে অনেক ব্যাপারেই রাজি হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নয়। ওরা সংশ্লিষ্ট দেশের বাজার বুঝে, নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের দিকটি ভাল করে বুঝে তবেই এগোয়। অনেকগুলি দেশের সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়ানো চিনের ধাতে নেই।” |