শেষ কথা নাটকের উৎকর্ষই,
দরকারে বাধা নয় দলের গণ্ডি
পাঁচটি চরিত্র। চারটিতে অভিনয় করছেন মঞ্চের চার ‘তারকা’ অভিনেতা-অভিনেত্রী। ২৭টা শো হয়ে গিয়েছে। টানা হাউসফুল।
‘কন্যাদান’ নাটকের এই সাফল্যের পিছনে অভিনয়ের উৎকষর্কেই এক নম্বরে রাখছেন পরিচালক ব্রাত্য বসু। দর্শক-সমালোচকরাও বলছেন, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, সোহিনী সেনগুপ্ত এবং ব্রাত্যর অভিনয় দেখতে ভিড় করছেন তাঁরা। বিজয় তেন্ডুলকরের বিখ্যাত নাটকটি জীবন্ত হয়ে উঠছে তাঁদের অভিনয়ে। এবং সেটা সম্ভব হচ্ছে বাংলা নাটকের চলতি রেওয়াজের সুবাদেই। কী রেওয়াজ? অভিনেতা-নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় বৃত্তের বাইরে বেরনো।
সাবেক গ্রুপ থিয়েটারের কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর নিজস্ব তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকতেন। সেই দলের নাটকেই তাঁদের অভিনয় দেখতে পাওয়া যেত। কালেভদ্রে বিশেষ আয়োজনে কিছু সম্মিলিত অভিনয় হত। কিন্তু এখন দলের বাইরে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে আসাটাই চলতি রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রাত্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ধারাটা শুরু করেছিল উইঙ্কল টুইঙ্কল। ব্রাত্যর লেখা, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সে নাটকে চরিত্রের দাবি অনুযায়ী ছিলেন দেবশঙ্কর হালদার, রজতাভ দত্ত, মায়া ঘোষের মতো অভিনেতা-নেত্রীরা। তার পর একের পর এক নাটক সেই পথে হেঁটে সাফল্য পেয়েছে। উইঙ্কল টুইঙ্কল, ফ্যাতাড়ু, রুদ্ধসঙ্গীত, বিসর্জন, কাছের মানুষ, রক্তকরবী, বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল... উদাহরণ প্রচুর। শুধু দেবশঙ্কর হালদার অভিনীত নাটক নিয়েই একটি গোটা উৎসব হয়ে গিয়েছে এ শহরে। এই মুহূর্তে বিভিন্ন দলের প্রযোজনায় গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, সুপ্রিয় দত্তরা দাপিয়ে অভিনয় করছেন। মঞ্চে আবারও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সুদীপ্তা চক্রবর্তী, চৈতী ঘোষাল, রজতাভ দত্তদের। দেবেশের কথায়, দলীয় কাঠামোর চেয়ে ইদানীং প্রযোজনার উৎকর্ষের দিকটা বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
‘কন্যাদান’ নাটকে সোহিনী সেনগুপ্ত ও মেঘনাদ ভট্টাচার্য। ছবি বিজয় মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে
সোহিনী সেনগুপ্ত এই প্রসঙ্গে ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘কন্যাদান’ নাটকটির আয়োজক-প্রযোজক তথা অভিনেতা বিজয় মুখোপাধ্যায় কিন্তু নাটকের দলের প্রথাগত কাঠামোর মধ্যে পড়েনই না সে ভাবে। কারণ, বিজয়ের দলকে সে ভাবে ‘দল’ বলাই যায় না। কিছু সহযোগী আছেন। বাকি সবটাই বাইরে থেকে নেওয়া। বিজয়কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজেও বলছেন, গ্রুপ থিয়েটারের সাবেকি কাঠামো ছেড়ে অনেকটাই পেশাদারি প্রযোজকের ধাঁচে তৈরি হয়েছে তাঁর সংস্থা। গোটা ভাবনাটাই প্রযোজনা-ভিত্তিক। নাটক বাছাই করে তার পর কথা বলা হচ্ছে পছন্দের পরিচালক-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে। তাঁরা আসছেন, একত্রে কাজ করছেন। হিট নাটক উপহার দিচ্ছেন। ‘কন্যাদান’ এ বছরের অন্যতম বড় হিট শহরের মঞ্চে। গড়ে ৫০ হাজার টাকার বিক্রি আছেই। মন্ত্রিত্বের কারণে ইদানীং ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ব্রাত্য। সে কারণে প্রায় ২৫টি আমন্ত্রিত শো নেওয়াই যায়নি বলে জানাচ্ছেন বিজয়।
গ্রুপ থিয়েটারের চলতি কাঠামোর সঙ্গে এই মডেলের তফাৎ কোথায়? দর্শক টানতে তারকা-পরিচালক বা তারকা-অভিনেতা নিয়ে কাজ করার প্রবণতা বাড়লেও দলের নিজস্ব ছেলেমেয়ের একটা গোষ্ঠী কিন্তু থাকেই। সৌমিত্র মিত্রও আদ্যন্ত পেশাদারি দৃষ্টি থেকে গড়ে তুলেছেন তাঁর দল। চতুরঙ্গ, পটলবাবু ফিল্মস্টার, রক্তকরবী বাণিজ্যিক সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু সৌমিত্রর দলেও ২৫-২৭ জন ছেলেমেয়ে আছে। সৌমিত্র জানাচ্ছেন, “আমার দলে কোন নাটক কোন পরিচালককে দিয়ে করানো হবে, কোন কোন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বাইরে থেকে নেওয়া হবে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হয়। বাকি চরিত্রে মূলত দলের ছেলেমেয়েরাই থাকে। নান্দীকার-বহুরূপীর মতো দল বাদ দিলে আজকের বেশির ভাগ দলই এই রাস্তা নিচ্ছে।” নাট্য প্রযোজনার এই নতুন ধারাকে কী চোখে দেখছেন নান্দীকারের সোহিনী? “দেখুন, এর ভাল-মন্দ দু’টো দিকই আছে। অনেক ভাল ভাল প্রোডাকশন হচ্ছে। অনেক ছোট দলও বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখছেন। দেবশঙ্কর হালদার অভিনয় করছেন বলে কত নাটক হাউসফুল হয়েছে! সেটা এক অর্থে ভাল তো বটেই। কিন্তু দলের ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করে বাইরের অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে সহজ শর্টকাট যদি খোঁজা হয়, সেটা ঠিক নয়।”
বহু দলই নিজস্ব অভিনেতাদের জন্য সরকারি অনুদান নিয়েও যে ভাবে বাইরে থেকে তারকা ‘ভাড়া’ করার রাস্তায় হাঁটছে, প্রশ্ন আছে তাই নিয়েও।
কিন্তু ‘কন্যাদানে’র বিজয় মুখোপাধ্যায় প্রথাগত ‘দল’ গড়ার কথাই ভাবেননি। পেশায় কর্পোরেট-কর্তার সাফ কথা, “নিজে অনেক দিন গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমার মনে হয়েছে, নাটককে ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল এবং জনপ্রিয় করতে হলে অন্য ফর্মুলায় হাঁটতে হবে।” সেই ফর্মুলাটা কী? “নাটক, পরিচালক, অভিনেতা, মঞ্চ, আলো, সঙ্গীত কোনও দিক থেকেই উৎকর্ষের সঙ্গে আপস না করা।” অর্থাৎ, দলের চেয়ে প্রযোজনায় মনোনিবেশ করা। ‘২২১ বি বেকার স্ট্রিট’ নাটকে অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ও এই ফর্মুলাই নিয়েছিলেন। সে নাটকে একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন দেবশঙ্কর এবং সুরজিৎ।
অন্য রকম উদাহরণ কি নেই? নতুন তারকা তবে তৈরি হবে কী করে? সোহিনীর কথায়, “আমার কাছে নাটকের আদর্শ যদি বলেন, আমি কিন্তু বলব, মাধবী। একটা দলের নিজস্ব স্পিরিট, নিজস্ব অভিনেতা, নিজস্ব পরিচালক সব কিছু আছে এর মধ্যে। ৭৮টা শো হয়ে গেল। এখনও হাউসফুল। এবং নামী অভিনেতাদের পাশাপাশি তরুণ অভিনেতাদের দৃশ্যেও একই রকম হাততালি দিচ্ছেন মানুষ।” সৌমিত্র মনে করিয়ে দিলেন ‘দেবী সর্পমস্তা’র কথা। যেখানে অভিনয় করছেন এক ঝাঁক তরুণ শিল্পী। উইঙ্কল-টুইঙ্কল বা বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল-এর পরিচালক দেবেশই ‘সর্পমস্তা’ করেছেন। দেবেশের বক্তব্য হল, “এখন কাজের গতি এত বেশি, কম সময়ে দুর্বল পরিকাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হলে তৈরি অভিনেতাদের নেওয়া দরকার। অনেক সময় চরিত্রের নিজস্ব দাবিও খুব বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু দলে উপযুক্ত ছেলেমেয়ে থাকলে তাদের বঞ্চিত করার পক্ষপাতী নই। নতুনরাও যে সুযোগ পেলে ভাল কাজ করে, ‘সপর্মস্তা’ই তার প্রমাণ। আর নাটক ভাল না হলে শুধু তারকা দিয়ে লাভ হয় না।”
নাটকের সামগ্রিক স্বার্থের বিচারে আরও একটা বিপদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ব্রাত্য। কন্যাদানের পরিচালকের স্পষ্ট বক্তব্য, “শুধু তারকা হলেই হবে না। ভাল অভিনয়ের সঙ্গে সেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাটকের প্রতি
দায়বদ্ধতা থাকা প্রয়োজন। সিনেমা-সিরিয়ালের ফাঁকে একটু নাটক করে নেওয়ার মন নিয়ে এলে কিন্তু তারকার হাত ধরে বিশেষ কোথাও পৌঁছনো যাবে না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.