বুঝিয়ে দিল শিশুকন্যার মৃত্যু
শিশু-চিকিৎসকদের জন্যও জরুরি ক্যানসার-প্রশিক্ষণ
চিকিৎসার পদ্ধতি ও চিকিৎসকের সচেতনতা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল একটি মর্মান্তিক মৃত্যু। টানা বছর দেড়েক ‘নিছক’ সর্দি-জ্বরে ভুগতে ভুগতে মারা গেল পাঁচ বছরের শ্রী মুখোপাধ্যায়। এই দীর্ঘ সময়ে তার অ্যালার্জির চিকিৎসা হয়েছিল। কিন্তু কোনও রক্তপরীক্ষা হয়নি। সেই পরীক্ষা যে দিন হল, সে দিনই জানা গেল, শ্রী লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। আর সেটাই ছিল তার জীবনের শেষ দিন। স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং বেলেঘাটা বাইপাসের যে বেসরকারি হাসপাতালে শ্রী ভর্তি ছিল, সেখানকার কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে শ্রীর বাবা-মা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন উপসর্গ দেখে একাধিক চিকিৎসক মারণ রোগের আভাসটুকুও পেলেন না? টানা দেড় বছরে কোনও চিকিৎসকেরই কেন রক্ত পরীক্ষা করানোর কথা মাথায় এল না? প্রশ্ন উঠেছে, শিশুদের মধ্যে ক্যানসার যখন ক্রমশ বাড়ছে, তখন শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞদের কি ক্যানসার সম্পর্কে আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া বা সচেতন করা উচিত? ক্যানসার চিকিৎসকদের মতে, এটা অবশ্যই জরুরি।
শ্রীর বাবা সুমন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে ছিলাম। তাই চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এখানকার দূষণের জন্য ওর সমস্যা হচ্ছে। অ্যালার্জির চিকিৎসাই আগাগোড়া করে গিয়েছেন তাঁরা। এমনকী, সেই চিকিৎসার জন্যও কোনও রক্তপরীক্ষা করাননি। করালে আমাদের সন্তানকে এ ভাবে ভুল চিকিৎসায় হারাতাম না।”
দেড় বছরের অসুস্থতায় রক্ত পরীক্ষা না করানোর এই নজির যদি বিরল হয়, তা হলে তারই পাশাপাশি আরও একটি বিরল ঘটনা হল, শ্রীর মৃত্যুর পরে চিকিৎসকের ভূমিকা। যে চিকিৎসক আগাগোড়া তার চিকিৎসা করেছেন, সেই অঞ্জন ভট্টাচার্য ঘটনার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমারই ভুল। ওর উপসর্গ দেখে অ্যালার্জি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম বলেই সেই চিকিৎসা করেছিলাম। এক বারের জন্যও সন্দেহ হয়নি যে, ওর ক্যানসার হয়েছে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “বাচ্চাদের ঘনঘন রক্তপরীক্ষা করানোর আমি বিরোধী। আমি প্রধানত উপসর্গ দেখেই চিকিৎসা করি। তবে, নিজের মূল্যায়নে আর বিশ্বাস থাকছে না আমার। এর পরে আরও বেশি সতর্ক থাকব। এই ঘটনা আমাকেও বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে।”
হঠাৎই জ্বর বেড়ে যাওয়া এবং বুকে ব্যথা শুরু হওয়ায় গত ১২ সেপ্টেম্বর শ্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেড় বছরের মধ্যে সে দিনই প্রথম রক্তপরীক্ষা হয় তার। আর জানা যায়, সর্দি-জ্বর বমির উপসর্গের পিছনে আসলে লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যানসারে ভুগছিল সে। হিমোগ্লোবিন নেমে গিয়েছিল ৪.৪-এ।
বাইপাসের যে হাসপাতালে শ্রীর চিকিৎসা হয়েছিল, সেই হাসপাতালেই শিশুদের মনোবিদ হিসেবে যুক্ত শ্রীর মা বৈশালী মুখোপাধ্যায়। তবে, ওই ঘটনার পর থেকে তিনি সেই হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “মেয়েটা কত কষ্ট পেয়ে মরে গেল। সঠিক চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারলাম না। প্রত্যেক বাবা-মাকে অনুরোধ, বাচ্চার জ্বর-সর্দি হলে সামান্য অসুখ বলে যেন অবহেলা না করেন। চিকিৎসকদের উপরে অন্ধ বিশ্বাস করলে আমাদের মতো হাহাকার করতে হতে পারে।”
স্কুলে যাওয়ার পরে মাঝেমাঝেই জ্বর আসত শ্রীর। আর বমি করে ফেলত বারবার। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, অ্যালার্জির পাশাপাশি এটা ‘স্কুল ফোবিয়া’ও হতে পারে। অগস্ট মাসে শ্রীকে এক বার দেখেছিলেন শিশু-চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ। তিনি বলেন, “সর্দি-কাশি, বমির উপসর্গ নিয়ে এলে কোনও চিকিৎসকই গোড়ায় রক্ত পরীক্ষা করান না। আমিও করাইনি। লিউকেমিয়ার উপসর্গ থাকলে অবশ্যই তা করানো হত। তা ছাড়া, দেড় বছর ধরে অসুখটা বাচ্চাটির শরীরে ছিল, এটা আমি মনে করি না। এটা এমনই রোগ, যা হুহু করে ছড়ায়। এ ক্ষেত্রেও তেমনই হয়ে থাকতে পারে।” শিশু-চিকিৎসক অমিতাভ পাহাড়ি জানিয়েছেন, তিনি এক বারই শ্রীকে দেখেছিলেন। কী অবস্থায় দেখেছিলেন, তা এখন আর তাঁর মনে নেই। পাশাপাশি তাঁর দাবি, “এটা নিশ্চিত, সেই সময়ে লিউকেমিয়ার কোনও উপসর্গ ছিল না। থাকলে রক্ত পরীক্ষা করাতে অবশ্যই বলতাম।”
শিশু-চিকিৎসকদের ক্যানসার প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি কি না, সেই প্রসঙ্গে শিশু-চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ওয়েস্টবেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স’-এর সভাপতি ঋতব্রত কুণ্ডু অবশ্য মনে করেন, শিশু-চিকিৎসকেরা বর্তমানে এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ও সচেতন। তাঁর বক্তব্য, “বাচ্চাদের ক্যানসারের লক্ষণগুলি অনেক সময়ে প্রকাশ পায় না। তাই কিছু ক্ষেত্রে বুঝতে ভুল হতে পারে।”
তবে, ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেকে অন্যান্য ক্ষেত্রের চিকিৎসকদের মধ্যে ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এ বিষয়ে সরকারি স্তরে সংগঠিত উদ্যোগ দরকার। পাশাপাশি তিনি বলেন, “এত দিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশির পরেও এক বারও রক্তপরীক্ষা করানো হল না, এটা খুব আশ্চর্যের। শিশুদের লিউকেমিয়া যেহেতু কোনও বিরল ঘটনা নয়, তাই উপসর্গ দেখে চিকিৎসকদের সেটা আন্দাজ করা উচিত ছিল।”
হেমাটোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “এ দেশে বাচ্চাদের সাধারণত যে ধরনের লিউকেমিয়া হয়, যথাযথ চিকিৎসায় তার অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সেরে যায়। দেড় বছর তো অনেকটা সময়। গোড়া থেকেই চিকিৎসা শুরু হলে শ্রী হয়তো বেঁচে যেত।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.