জোড়া মামলায় বিচার-প্রত্যাশী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
আজ, বুধবার।
একটি মামলা আইনের আদালতে। যেখানে সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকের জমি ফেরত দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকারের তৈরি আইন সংবিধানসম্মত কি না, তা নিয়ে রায় দেওয়ার কথা কলকাতা হাইকোর্টের।
অন্য মামলাটি জনতার আদালতে। যেখানে ভবানীপুরের ‘ঘরের মেয়ে’ তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘পরীক্ষা’! তাঁর ‘পরীক্ষা’ যতটা না প্রথম বার বিধায়ক হওয়ার, তার চেয়ে ঢের বেশি বড় ব্যবধানে জেতার। উপনির্বাচনে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ৪৪.৮৯%। ভোটদানের স্বল্প হারের মধ্যেও মমতা বড় ব্যবধানে জিতে আসেন কি না, তাঁর ‘পরীক্ষা’ সেখানেই! |
দুই মামলাই ‘মমতার রাজনীতি’র প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গণ-আদালতের মামলাই যে তাঁকে এবং তাঁর দলকে একটু হলেও বেশি ‘টেনশনে’ রেখেছে, রায়ের ২৪ ঘণ্টা আগে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া থেকেই তা স্পষ্ট। নজরুল মঞ্চে মঙ্গলবার তৃণমূলের মুখপত্রের ‘উৎসব সংখ্যা’র প্রকাশ অনুষ্ঠানে মমতা বলেছেন, “ভবানীপুরের ফল নিয়ে বেশি প্রত্যাশা করবেন না কেউ! তবে বসিরহাটে জিতব।” মমতার নিজের ব্যাখ্যায়, “ভবানীপুরে কম ভোট পড়েছে। কাউকে দোষ দিচ্ছি না। এমনিতেই উপনির্বাচনে ভোটের হার কম হয়। অনেকে বাইরে থাকে। তার উপরে তিন মাস আগেই একটা ভোট হয়েছে। ভবানীপুরে বৃষ্টি হয়েছে ভোটের দিন, বসিরহাটে হয়নি।”
সিঙ্গুর মামলার রায় নিয়ে আগাম কোনও মন্তব্য করতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’দের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেই বিধানসভা ভোটে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্তও ছিল তা-ই। কিন্তু তার জন্য বিধানসভায় রাজ্য সরকার যে আইন পাশ করেছিল, তার সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলে আদালতে গিয়েছে টাটা মোটরস।
ভোটের হার কম হলে জয়ের ব্যবধানও কম হবে সহজ অঙ্ক তা-ই বলে। মমতা নিজেও বিলক্ষণ জানেন, ভবানীপুরে উপনির্বাচনে ভোটের হার যা হয়েছে, তাতে তাঁর জয়ের ব্যবধান নিয়ে ‘সংশয়’ আছে বিভিন্ন মহলে। সেই জন্যই মমতা নজর ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন বসিরহাট উত্তরের দিকে। তাঁর কথায়, “কাল (বুধবার) আর একটা বেশি আসন পাব। এটা আমার আশা। জিতলে খুশি হব। না-জিতলে দুঃখ নেই।” বিধানসভা ভোটে বসিরহাট উত্তর আসনটি জিতেছিল সিপিএম। ওই কেন্দ্রের বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে উপনির্বাচন থেকে আসনটি যদি তৃণমূল সিপিএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে, তা হলে মমতা বলতে পারবেন, ‘পরিবর্তনে’র হাওয়া এখনও কাজ করছে।
চার মাস আগের বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুরে ভোটের হার ছিল ৬৩.৭৭%। তার মধ্যে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী পেয়েছিলেন ৬৪.৭৭%, সিপিএমের নারায়ণ জৈন ২৭.৯৮%। বিজেপি সেখানে ভোট পেয়েছিল ৩.৭৪%, এ বার যারা ভবানীপুরে প্রার্থী দেয়নি। সুব্রতবাবুর জয়ের ব্যবধান ছিল ৫০ হাজারের কাছাকাছি। এ বারের কম ভোটদানের হারের মধ্যেও প্রার্থী মমতা কত শতাংশ ভোট পান, মূল কৌতূহল তা নিয়েই। স্বয়ং মমতা বলেছেন, “কত ভোট পড়েছে, তার শতাংশের হিসাবটা দেখে নেবেন! জেতা জেতাই!”
ভবানীপুরে এ বার ভোট কম পড়ায় মমতার জয়ের ব্যবধান প্রত্যাশিত হবে না বলে তাঁর দলেরই একাংশ উদ্বিগ্ন। সে ক্ষেত্রে মমতার জয়ের ব্যবধানের চেয়েও ভোটপ্রাপ্তির শতাংশের হারই মুখ্য বিবেচ্য হতে চলেছে। অর্থাৎ সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে মমতা কত ভোটে হারালেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হবে সুব্রতবাবুর চেয়ে মমতার ভোটপ্রাপ্তির হার বেশি হল কি না।
দলীয় মুখপত্রের অনুষ্ঠানেও এ দিন তৃণমূল নেতাদের একাংশ ভবানীপুরের হিসাব-নিকাশ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। বিরোধী সিপিএম অবশ্য মমতার ভোটে কম ভোটদানের হারকেই ‘ইঙ্গিতবহ’ বলে ধরতে চাইছে। দলের এক নেতার কথায়, “ফলাফল যা-ই হোক, নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও ভবানীপুরের ৫৫% মানুষ ভোট-প্রক্রিয়ায় অংশ নেননি, এটা ইতিমধ্যেই নথিভুক্ত।” বৃষ্টি, উৎসবের মরসুম ছাড়াও তৃণমূল নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের জেরে বারবার ভোট ‘চাপিয়ে’ দেওয়াকে মানুষ ভাল ভাবে নেননি এই ভাবেই বিষয়টিকে দেখাতে চাইছে সিপিএম।
সকাল ৮টা থেকে আজ ভবানীপুরের ভোটগণনা হবে হেস্টিংসে। বসিরহাটের গণনা বসিরহাট কলেজে। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্ত এ দিন বলেন, “ভবানীপুরের প্রতি রাউন্ডে ১৪টি করে বুথের গণনা হবে। ওই কেন্দ্রে মোট বুথ ২৬৪টি। বসিরহাট উত্তরের প্রতি রাউন্ডে ২৮টি করে বুথের ভোট গণনা হবে।” ফলে, বেলা গড়ানোর আগেই ফল জানা যাবে।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর মামলার রায় ঘোষণা করার কথা সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ। মঙ্গলবারই মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরে গিয়ে জানিয়েছিলেন, আদালতের রায়ের পরেই পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে রাজ্য সরকার। বস্তুত, এই রায় যে পক্ষেরই বিরুদ্ধে যাবে, তাদের উচ্চ আদালতে যাওয়া প্রায় অবধারিত। হাইকোর্টে শুনানি চলার সময় টাটা মোটরসের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল বারবার বিচারপতির কাছে অভিযোগ করেছেন, রাজ্য সরকার ‘অবৈধ ভাবে’ সিঙ্গুর আইন প্রণয়ন করে জোর করে জমির দখল নিয়েছে। এবং আইনে কোনও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। রাজ্য সরকারের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্র ও সরকারি কৌঁসুলি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বিচারপতিকে জানিয়েছেন, সিঙ্গুরের জমি জোর করে অধিগ্রহণ করা হয়নি। টাটা মোটরস জমি ফেলে রেখেছিল বলেই রাজ্য সরকার আইন করে তার মালিকানা স্বত্ব ফিরিয়ে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে টাটা মোটরসের কোনও ক্ষতিপূরণ পাওনা থাকলে রাজ্য তা মিটিয়ে দিতে রাজি।
শুনানির শেষ পর্যায়ে এসে বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ আইন মোতাবেক সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি তৈরি করে দেওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। টাটা মোটরস তাতে প্রবল আপত্তি জানায়। শুনানির শেষ দিন পর্যন্ত টাটার আইনজীবী সমরাদিত্যবাবু সিঙ্গুর আইনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের কাছে বিচার চেয়েছেন। প্রায় দু’মাস ধরে দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব শোনার পরে আজ চূড়ান্ত রায় দেবেন বিচারপতি। হাইকোর্টের এজলাস হোক বা হেস্টিংসের গণনা-কক্ষ গোটা রাজ্য তাকিয়ে থাকবে এক জনের দিকেই। বিচারপ্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! |