|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
পরিবেশভাবনার অধিকার নিয়েই প্রশ্ন |
জয়া মিত্র |
পরিবেশের জাতপাত, মোহিত রায়। গাঙচিল, ২০০.০০ |
সাম্প্রতিক কালে বাংলায় পরিবেশবিষয়ক লেখালিখিতে মোহিত রায় একটি পরিচিত নাম। তাঁর পরিবেশভাবনার কিছু বিশেষত্বও আছে। পরিবেশের জাতপাত নামে চমৎকার চেহারার বইটি এই লেখকের গত প্রায় এক দশকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রচনার সংকলন। প্রবন্ধগুলির বিষয় বিভিন্ন। কলকাতা শহরের পুকুর নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক মায়াময় রচনা, যেটি ওল্ড মিররস নামে ইংরেজি অনুবাদে একটি আলাদা বই হিসাবেও প্রকাশিত হয়েছে, থেকে শুরু করে শহরের গরফা, যাদবপুর কি হুগলির মতো এলাকার স্থানীয় সমস্যার রিপোর্ট, ‘গরিব দেশ’-এর স্বাস্থ্য, দূষণ ও উন্নয়ন ভাবনা, বিভিন্ন ছোটখাট পরিবেশ আন্দোলনের গুরুত্ব বা অর্থহীনতা, উত্তরবঙ্গের চাঁদমনি চা-বাগানের মতো নানান বিষয়।
প্রথম লেখাটি অত্যন্ত মনোজ্ঞ, বাঙালি পাঠকের কাছে চিত্তাকর্ষক। এখানে লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের অসাধারণ ঘনাদাকাহিনিগুলিকে সমকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পটভূমিতে বিস্তারিত করে দেখিয়েছেন। এদের প্রত্যেকটিই কোনও না কোনও ভাবে পরিবেশ সমস্যা বা সমস্যা-সমাধানের সঙ্গে যুক্ত। লেখাগুলি তথ্যে ঠাসা। যদিও কখনও কখনও সে তথ্য কিছুটা একদেশদর্শী, ফলে বিভ্রান্তিজনক। এবং, সমস্ত বইটি জুড়ে লেখক নিজস্ব মতামত প্রায় পিতৃতান্ত্রিক ধরনের জোরের সঙ্গে, পরমতঅসহিষ্ণু ভাবে প্রকাশ করেছেন। আধুনিক পরিবেশ ভাবনার বৈশিষ্টই নম্রতা, মতানৈক্যের প্রতি সহনশীলতা, সেটি আলোচ্য বইয়ে চোখে পড়ে না। যেমন ধরা যাক, আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে যে অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়ে, তা হল কৃষি। এই কৃষি বিষয়ে মোহিত বলছেন, ‘জনবিস্ফোরণ সত্ত্বেও সারা পৃথিবীর খাদ্যের যোগান আজও কমেনি... উন্নত বীজ, কৃষিবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সেচ, সার, কীটনাশক, সব কিছুর যোগাযোগে পৃথিবীর প্রধান দুটি শস্য ধান বা গমের উৎপাদন হার কয়েকগুণ বাড়ানো গেছে’ (পৃ ১০১)। প্রথমত, ‘খাদ্যের যোগান আজও কমেনি’ হিসেবটি তিনি পেলেন কোথায়, যখন কিনা রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে ভারত সরকারের প্রতিটি রিপোর্টেই এর বিপরীত কথা বলা হচ্ছে? আর ‘উন্নত বীজ, কৃষিবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সেচ, সার, কীটনাশক’! ১৯৮০-র দশকে FAO-এর তৎকালীন সচিব জে ওবেইদুল্লা বলেছিলেন, ‘এই জলনিবিড়, কীটপতঙ্গ হত্যাকারী কৃষি ব্যবস্থা থেকে পৃথিবীকে মুক্তি পেতেই হবে।’ ২০০২-এর অগস্ট মাসে বিশ্বব্যাঙ্ক ও ‘ফাও’-এর উদ্যোগে গঠিত কমিটির ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এ জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘নতুন বীজ, অফুরান জলের ব্যবহার, কৃষি রাসায়নিক দ্রব্য এবং প্রযুক্তির বিপুল প্রয়োগ সবই কৃষির পক্ষে খারাপ হয়েছে।’ উচ্চফলনশীল কৃষির যে প্রকৃত চেহারা অরুন্ধতী রায় তাঁর গ্রেটার কমন গুড বইয়ে স্পষ্ট করে দেখিয়েছিলেন তা-ও যদি ভুলে যাই, কী করে মুখ ফেরাব এই হিসেব থেকে যে, ১৯৯৭-২০০৭-এর মধ্যে কেবল ভারতবর্ষে আত্মহত্যাকারী কৃষকের সংখ্যা ১,৮২,৯৩৬? এই কি নয়া কৃষির উন্নয়নচিত্র?
পরিবেশ সমস্যার অন্য দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বিদ্যুৎ ও দূষণ সম্পর্কেও লেখকের মতামত প্রণিধানযোগ্য। ‘সম্প্রতি এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে কিছু শিল্পস্থাপন হচ্ছে। সে সঙ্গে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে।... পশ্চিমবঙ্গে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের আরও প্রসার (যা কেমিক্যাল হাব বলে পরিচিত) হলে নাকি দূষণে জর্জরিত হয়ে উঠবে রাজ্য। (হলদিয়া শিল্পাঞ্চল কিন্তু এখনই একটি কেমিক্যাল হাব যার দূষণ পরিস্থিতি আদৌ সমস্যা ঘটাচ্ছে না)’ (পৃ ১৪৮)। ২০০৭-এ লেখা এই নিবন্ধে প্রকাশিত চিন্তা বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করেও বলা যায় ‘গুজরাট হাইকোর্ট ও কিছু পরিবেশবাদী’র হস্তক্ষেপে গুজরাটে দূষিত জাহাজ ভাঙার কাজ বন্ধ হওয়াকে কিন্তু শিল্পবিরোধিতা বলেই মনে করেন আমাদের লেখক। কারণ ওই কাজ অনেক মানুষের জীবিকা ছিল (পৃ ১৩৬)। সাম্প্রতিক কাগজের খবর থেকে মেদিনীপুরে অস্ত্র তৈরি করা কত যুবকের জীবিকা ছিল তার একটা হিসেব নেওয়ারও আগ্রহ হতে পারে। গত দুই দশকে বাংলার অন্যতম শিল্প স্পঞ্জ আয়রন কারখানা সম্পর্কে কোনও আলোচনা বা উল্লেখ অবশ্য নেই বইয়ে, কিন্তু নদীজল দূষণের ক্ষেত্রেও বিপদ কেবল মানুষের শরীর-বর্জ্য ঘটিত (পৃ ১৭৯)। নদীতীরে কোনও কারখানা রাসায়নিক বর্জ্য জলে ফেলছে কিনা অথবা বাঁধ কিংবা পাম্প সেচের ফলে নদী কোথাও স্রোতহারা দূষিত কিনাতা লক্ষ করার কোনও প্রশ্ন নেই। ‘যার ঘরে এখনও জ্বলে কেরোসিনের কুপি তার কাছে সৌরবিদ্যুৎ বনাম কয়লার বিদ্যুৎ বনাম পারমাণবিক বিদ্যুতের তুলনামূলক দূষণের চর্চা শুধু অসার নয় অপমানেরও। তার চাই বিদ্যুৎকালকেই।’ (পৃ ১৩২)। শঙ্খ ঘোষের লাইনটি মনে পড়ে, ‘ভিখিরির আবার পছন্দ’। কিন্তু উৎপন্ন বিদ্যুতের কত অংশ বাস্তবে ব্যয় হয় শহরে শহরে রাত আলো করা বিজ্ঞাপনের উদ্ভাসনে, অসংখ্য শপিং মল বাতানুকূল রাখতে আর কতটা যায় গ্রামের কুটিরে আলো জ্বালতে তার কোনও পূর্বিতা কি সত্যিই লেখকের মনে থাকে? হয়ত থাকে না। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎহীন সভ্য মনুষ্যজীবন যাপন সম্ভব? ভারতে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার ২৭০ কিলোওয়াট ঘণ্টা... ব্রিটেনে ৬০০ কিলোওয়াট ঘণ্টা, এমনকী প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের মতো হতে হলেও মাথাপিছু ৪ গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। ... এ তো আমাদের কালকেই দরকার’ (পৃ ১০৩)। কেন ‘কালকেই’? কী বাস্তবতা এই দাবির? এই প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে সেই ক্ষীণদেহ মানুষটির কথা যিনি বলেছিলেন, ‘আই ওয়ান্ট আ ইন্ডিয়া মোর ইন্ডিয়ান। ব্রিটেন যে জীবনযাপন করে সে জন্য তাকে অর্ধেকটা পৃথিবীকে উপনিবেশ বানাতে হয়েছে...।’ আর এই মানুষটির নাম প্রসঙ্গেই রয়েছে এই বইয়ের সবচেয়ে রূঢ়, অসৌজন্যমূলক পংক্তিটি, ‘গান্ধীবাদী বা আধুনিক পরিবেশবাদীদের চাই... দেশজ প্রযুক্তি, দেশজ কৃষির নামে... এক দলের বিলাস। এই বিলাস অনেক সময়েই বিদেশি অর্থে লালিত।’ (পৃ ১৩০)।
আসলে মোহিত বিশ্বাস করেন পরিবেশ নিয়ে ভাবনা করার অধিকার সকলের নেই। তিনি নিজেই ভাগ করেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানশিক্ষিত পরিবেশ-বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ আর বাকি সব বিজ্ঞান-না-জানা, আবেগসর্বস্ব হাবিজাবি পরিবেশবাদী যারা কেবল বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধা দেয় আর বিশেষজ্ঞদের কথা শোনে না। পুরো বইটিতে, এমনকী প্রসঙ্গবিহীন ভাবেও, সেই ‘পরিবেশবাদী’দের সম্পর্কে বিদ্রূপ ও বিষোদ্গারে তাঁর ক্লান্তি দেখা যায় না, যদি সেই তীব্রতা তাঁর লেখার সাহিত্যগুণকে ব্যাহত করে, তবুও। ঠিক যে রকম তিনি বিদ্বেষ চেপে রাখতে পারেন না পূর্ববাংলা পরে বাংলাদেশ থেকে এসে পড়া ‘জনপ্লাবন’ কিংবা মুসলমান সমাজের উপর। তিনি বিশ্বাস করেন জ্ঞানও এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা। এটা সকলের আয়ত্তের বিষয় নয়। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাধারায় মোহিত ভাবেন পরিবেশ ও জীবনযাপন সম্পর্কে শেষ কথা তিনিই জানেন, ‘রসাতলের কাছাকাছি রয়েছি আমরা ভারতীয় জনসাধারণ’ (পৃ ১০২), ‘আন্দামানের মুক্ত বন্য জারোয়াদের জীবন আদৌ মানুষের কাম্য নয়’ (পৃ ১৩৪), ‘যে কোনও মানুষই চায় উন্নততর জীবন’ (ঐ)। আর সেই উন্নততর জীবন কেমন? ‘আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে সুন্দরবনের অরণ্য যদি না থাকে তবে ঝড়ে বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তাই নাকি? ভূমিকম্পপ্রবণ জাপানে বহুতল বাড়ি বানানো হচ্ছে অনেক বছর ধরে, সেগুলো সব টপাটপ ভেঙে পড়ছে না। সুন্দরবনের বাসিন্দারা যদি ধনী হন তবে নিশ্চিন্তে পাকা শক্তপোক্ত বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারেন, কোনও ঝড়েই কিছু আসবে যাবে না। আর ধনী হতে গিয়ে যদি সুন্দরবনের অরণ্যসম্পদ অনেকটাই ব্যবহার করে ফেলতে হয় তাতে কী আসে যায়। কিছু বাঘ কমে যাবে, তা ইউরোপেও তো বাঘ নেই।’ (পৃ ১৪৮)।
বিশ্বাস করা যায়, এই সব কথা বলতে পারেন কোনও পরিবেশবিজ্ঞানী? |
|
|
 |
|
|