সময়টা ২০০০ সাল। এ যাবৎ কালে সব থেকে ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে গোটা রাজ্য। সে বারের দুর্গাপুজো কার্যত বাঁধ ভাঙা বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল। পুজোর কথা ভাববার সময়ই ছিল না ত্রাণ শিবিরে থাকা মানুষের।
নবদ্বীপ সেবার পুজোর সময় ৮ ফুট জলের তলায়। সমস্ত বারোয়ারি পুজো বন্ধ। কোথাও এক মানুষ জল, কোথাও বুক পর্যন্ত। কিন্তু সেই চরম দুর্যোগের দিনেও পুজো হয়েছিল। চিরাচরিত মণ্ডপ থেকে প্রতিমা সরিয়ে ক্লাবের দোতলায় দুর্গাপুজো করেছিলেন নবদ্বীপের আজাদ হিন্দ ক্লাব। জলে ডোবা রাস্তার দু’ধারে অনেক উঁচু পোস্টে মাইক বেঁধে শোনানো হয়েছিল মহালয়া। পুজোর চার দিন আলোর মালায় সেজেছিল জলে ডোবা বাড়ির কার্নিস, ছাদ। আর সে আলোও জ্বলেছিল নৌকায় ভাসমান জেনারেটরের সাহায্যে। বন্যা পীড়িত প্রায় চার হাজার এলাকবাসীকে নিয়মিত খাওয়ানো হয়েছিল মায়ের প্রসাদ খিচুরি ভোগ।
আর এই বানভাসি সালের পুজোর পর থেকেই বদলে গিয়েছে নবদ্বীপের সব থেকে বড় বাজেটের পুজোর চরিত্র। পুজোর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা শুভাশিস কংসবণিক বলেন, “সাড়ে তিন দশকের এই পুজোয় ২০০০ সালের আগে পর্যন্ত আমরা চাঁদার বই হাতে এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম। কিন্তু ২০০০ সালে চাঁদার প্রশ্নই ওঠেনি। এলাকার বহু মানুষ ঘরছাড়া। সে বার আমরা সদস্যদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে পুজো করেছিলাম। ব্যাস সেই শুরু। তারপর থেকে ১০ বছর ধরে আমাদের ক্লাবের পুজোয় এলাকাবাসীর কাছ থেকে আর চাঁদা নেওয়া হয় না। চাঁদার বই ছাপানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু কাল।”
তিনি জানান, সেই বন্যার বছরেই তাঁরা দেখেছিলেন, সদস্যদের টাকাতেই পুজো তুলে দেওয়া সম্ভব। যে এলাকায় সেই পুজো হয়, সেই রানিরচরা প্রধানত নিম্নবিত্ত মানুষের বাস। শুভাশিসবাবু বলেন, “সেই বছরই আমরা দেখেছিলাম, চাঁদার টাকায় পুজো করলে বাজেট যা হবে, নিজেরা টাকা দিয়ে করলে বাজেট তার থেকে আনেক বেশি হয়ে যাবে।”
তিন মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজোর আয়োজন। তিনশো থেকে চারশো পরিবারে ছড়িয়ে থাকা ক্লাবের সদস্যদের অনেকেই থাকেন বিদেশে বা ভিন রাজ্যে। সুদৃশ্য খামে পুজোর বার্তা তাঁদের কাছে পৌঁছে যায় গুয়াহাটি থেকে দিল্লি, ওড়িশা থেকে আমেরিকা পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী এই সদস্যেরা ছাড়াও স্থানীয় সদস্যেরাও খোলা হাতে টাকা দেন।
আমেরিকাবাসী ইঞ্জিনিয়ার শিশির হালদারের বাবা শ্যাম হালদার বলেন, “ক্লাবের ছেলেদের আর এখন মনে করিয়ে দিতে হয় না। আমিই ছেলেকে মনে করিয়ে দিই, ঠিক সময়ে যাতে টাকাটা পাঠিয়ে দেয়। ও নিজে উপস্থিত থাকতে পারে না। কিন্তু তবু ওর উপস্থিতি যে থাকে, এটাই আমার সান্ত্বনা।” ওড়িশার নির্মাণ সংস্থার পদস্থ আধিকারিক মৃণালকান্তি সাহারায়, দিল্লির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পার্থ সাহারায়, গুয়াহাটির চিকিৎসক সৌমিত্র দাসও চেষ্টা করেন, সম্ভব হলে নিজেরাই উপস্থিত হতে। মুম্বইবাসী ইঞ্জিনিয়ার জয়রতন সাধুখাঁর দাদা জয়দেব সাধুখাঁ বলেন, “আজাদ হিন্দের পুজো এখন আমাদের বাড়ির পুজোর মতো। আমরাই পুজোর সব কথা জেনে ভাইকে খবর দিলে ও সেই মতো টাকা পাঠিয়ে দেয়।” উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এ বারের পুজোর বাজেট প্রায় তিন লক্ষ টাকা। |