পুজোর হাঁড়ি
ভিন স্বাদের
ময়দা-বিলাস

য়দার কি অপার মহিমা!
ফিনফিনে পুঁটলির আড়ালে শোভা পাচ্ছে লোভনীয় রংবেরঙের সাজ। যেন সেকেলে বড়-বাড়ির খাসমহলের কিনারে চিকের আড়ালে কোনও রহস্যময়ী। এক ঝলক দেখা অন্দরমহলের মেয়ে-বৌদের মতোই আকর্ষণীয়া। কলকাতার রাস্তায় এখন প্রায় জলভাত মোমো হেন একটি বস্তু দেখেও যে এমন মনে হতে পারে কে ভেবেছিল। এমন আশ্চর্য ময়দার ঠুলি আমবাঙালি খুব বেশি চাক্ষুষ করেনি। ময়দার মিহি পর্দার আড়ালে চোখ টানছে ঈষৎ আবছা সরস মাংস-চিংড়ি, কি মাশরুম বা লাল-সবুজ বাহারি সব্জির কুচি।
পুজোর কাউন্টডাউনে জ্বরাক্রান্ত মহানগরে মেনল্যান্ড চায়না-র ডিমসাম-উৎসবে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে। উৎসবে ‘ময়দা খাওয়া’র যোগ অবশ্যই বাঙালির কাছে নতুন নয়। এক পক্ষ অপরপক্ষকে এখনও মাঝেমধ্যে কথায় কথায় ‘ময়দা খাওয়া’ নিয়ে তুমুল আওয়াজ দিতে ছাড়ে না। অপরপক্ষের তাতে বয়ে গিয়েছে। আজকালকার স্বাস্থ্যবিশারদেরা হাঁ হাঁ করে উঠলেও সে-কালে এদেশিদের কাছে ময়দা আস্বাদন যেন এক ধরনের শৌর্যের প্রতীক। শোভাবাজার রাজ-বাড়ির এক কত্তাকে নিয়ে একটি সত্যি গপ্পো আছে। হার্ট অ্যাটাক না বাইপাস, কীসের পরে হাতিবাগানের নার্সিংহোমে তিনি তখন সদ্য সেরে উঠেছেন, তখনও হাতে স্যালাইন খোলা হয়নি, রোগশয্যায় ব্রেকফাস্ট এলে লুচি কেন দেওয়া হয়নি বলে ‘পেশেন্ট’ ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়লেন। পূর্ণিমার চাঁদের মত সুগোল লুচি ক্রমশ ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে সবার মজ্জায় মিশে গিয়েছে।
বহু বড়ঘরের পুজোয় মা দুগ্গাও তো পাঁচটা দিন অন্নস্পর্শ করবেন না। অব্রাহ্মণ পরিবারে ‘মা’ ও তাঁর ছেলেমেয়েদের অন্নভোগ দেওয়া নিষেধ। লুচি-রাধাবল্লভী-গজা-নিমকি-দরবেশ-পান্তুয়াদিতেই দেবী দিব্যি খুশি মনে ক’টা দিন কাটিয়ে দেবেন। সাদা ধবধবে ফুলকো লুচি দেখেই বহু পেটুকেরও শরতের সাদা মেঘকে মনে পড়ে। তা পুজোর মুখে ডিমসাম-উৎসব বসানোর সময়ে রেস্তোরাঁ-কর্তাদের বাঙালির এই ময়দা-সংস্কৃতি মনে পড়েছিল কি? কে জানে, তবে নানা কিসিমের অভিনব ডিমসাম-বাহারেই বঙ্গজীবনের এই নয়া ময়দা-অবতারের কথা মনে পড়ল।
ক্যান্টনিজ ভাষায়, এক ধরনের টুকিটাকি টাকনা এই ডিমসাম। তিব্বতিরা যাকে মোমো বলেন, তার মাধ্যমেই আমাদের ডিমসামের সঙ্গে আলাপ বড়জোর তিন দশক আগে। স্বচক্ষে দেখার আগে বহু বাঙালিই বোধহয় ফেলুদার ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু’-তে মোমোর একটা বর্ণনা পেয়েছিল। ‘মিটবল্স ইন সস’! পড়েই মোমো সম্বন্ধে একটা আগ্রহ ঘনিয়ে ওঠে। তখনও জানতুম না, এ কলকাতার মধ্যে আরও কয়েকটি কলকাতায় মোমোর রকমফের লুকিয়ে রয়েছে। শহরের আদি চিনে পাড়া টেরিটিবাজার বা ট্যাংরায় অসময়ে হানা দিয়েই ‘নুচি’র দেশের লোকে এক অন্য ‘ময়দা’র হদিস পেল। সাত-সকালে পোদ্দার কোর্টের চিনে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে মাংসের পুর-ঠাসা ভাপানো বানরুটি বা পাও খেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়েছি। পরে শুনেছি, ওই পাও-কে না কি চিনদেশে বাও বলে। বরবটির ডালের পুর দেওয়া এক ধরনের মিষ্টি পাও-ও আমরা চেখেছি। লুচির সঙ্গে স্বাদের মিল না-থাকুক, চিনেদের হাতের পাঁউরুটিও তো সেই ময়দাই হল। এলগিন রোডের মোমো-জয়েন্টগুলির সুবাদে আমাদের জীবনে তিব্বত এ বার রানাঘাটের থেকেও কলকাতার কাছাকাছি চলে আসবে। মোমো প্লাজা, টিবেটান ডিলাইট, অর্কিডে স্মরণীয় হয়ে আছে কলকাতার কত না নিভৃত নাগরিক দুপুর। শহরের ছোট-বড় চিনে রেস্তোরাঁগুলোর মেনুতে ডিমসামের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়েছে। মোমো, সুইমাই, ওয়ান্টান নানা রূপে ভাপা, ভাজা নানা আধারে লোভনীয় পুর-ঠাসা ময়দার কত না দেবা-দেবীর প্রকাশ।
মেনল্যান্ড চায়না-র ডিমসাম-উৎসবের ময়দা-খাওয়া অবশ্য খাঁটি চিনে রীতিতে। চিনেরা যাকে বলেন ‘ইয়াম চা’। ডিমসাম ওরফে বাঙালির মোমো মানে চিনেদের চায়ের সঙ্গে ‘টা’। সুগন্ধী জেসমিন, ওলং বা গ্রিন টি ফরমায়েশ করতে পারেন। ডিমসামও বাঁধা গতের নয়। চেনা ভাপা বা ভাজা বা হাল্কা ভাজা (প্যান ফ্রায়েড) ছাড়াও কেকের মতো বেক্ড ডিমসাম মিলবে। ছোট্ট আলু প্যাটির মতো কারিড চিকেন পাফ, গ্রিল্ড ডাক কেক এক মধুর বিস্ময়। শাকাহারীরাও কাব্যে উপেক্ষিত নন। সিঙ্গাপুরী শৈলীতে কারিপাতা, লেমন গ্রাসের ঘ্রাণে দীপ্ত কাঁকড়ার কেকও হাজির। সঙ্গী সসে অজানা চিনে হার্বের ফ্লেভার। আর এ ময়দা কিন্তু গমের নয়, হংকং ও চিনের গুয়াংদং প্রদেশ থেকে আনা এক ধরনের ম্যাজিক ময়দা যা ভাপানোর পরে প্রায় স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
পার্ক হোটেলের এগজিকিউটিভ শেফ শরদ দিওয়ান বলছিলেন, তাঁদের জেন রেস্তোরাঁয় ডিমসাম নিয়ে কলকাতার মাতামাতির কথা। কলকাতার রসিক জিভের জন্য ডিমসামের ইয়াম চা-রীতির সম্ভাবনাও জবরদস্ত বলে মনে করেন তিনি। কলকাতা আগে পার্কে চিনের চিজ ‘ইয়েলো গাউডা’-ঠাসা ডিমসামও উপভোগ করেছে। মুম্বইয়ের পার্কের মেনুতেও ‘ইয়াম চা’-এর বিশেষ খাতির। কলকাতার মোমো-হাটে উজ্জ্বল উপস্থিতি দক্ষিণ কলকাতার গল্ফগ্রিনে এক নবীন চাইনিজ ফুড চেন চাউম্যানেরও। চিনে ব্রেকফাস্ট খেতে যাঁরা পোদ্দার কোর্টে সকালে উঠে যেতে পারবেন না, তাঁরা চাউম্যানে যেতে পারেন। চিনেপাড়ার আদলে এই পাও-এর পেটে পর্ককুচির বদলে সরু ফালি-ফালি পর্ক রোস্ট।
এমনিতে ময়দা নিয়ে ডায়েটিসিয়ানদের ঘোর আপত্তি আছে। তবে কলকাতার ইয়াম চা উৎসবের জন্য নিয়ে আসা চিনে ময়দার কিছুটা অ্যাডভান্টেজ। মেনল্যান্ডের কর্পোরেট শেফ রাজেশ দুবে, শেফ দ্য কুইজিন ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্যেরা বোঝালেন, গমের ময়দার মতো এতে গ্লুটেন নেই। গ্লুটেনে অ্যালার্জির জন্য যাঁরা ময়দা এড়িয়ে চলেন, তাঁদের জন্য এটা খুশখবর! যদিও ময়দা-বিলাসী বাঙালি নির্ঘাত এ সব কচকচি না-ভেবেই ময়দায় মাতবেন।
পুজোয় বাড়িতে হেঁসেল-বন্ধ উপলক্ষে অষ্টমীর ময়দা মানে লুচি জোগাড় করা কষ্টকর হতে পারে তবে ঢের কম হ্যাপায় উৎসবের দিনে পাড়ায় পাড়ায় মোমো-ডিমসামেরা ভক্তের অপেক্ষায়।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.