ভেঙে গেল বিয়াল্লিশ বছরের জুটি!
ক্রিকেটের পিচে নয়। জীবনের পথে চলতে চলতে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে ‘নবাব’ তাঁর ‘বেগম’কে বলে গিয়েছিলেন, শিগগিরই ফিরবেন। ফিরলেন ঠিকই। কিন্তু নিথর হয়ে, অন্যের কাঁধে চেপে।
পটৌডি গ্রামের নবাবের হাভেলিও এত দিন মনসুর-শর্মিলাকে এক সঙ্গে দেখে এসেছে। আজ নবাবহীন আয়েষা বেগমকে দেখে যেন গুমরে উঠল সেই প্রাসাদ। যার প্রতিধ্বনি শোনা গেল গ্রামবাসীর মুখে। কান্নায় ভেঙে পড়ে তাঁরা আজ অন্তিম সেলাম জানালেন পটৌডির শেষ নবাবকে। দোকানপাট, স্কুল, সব বন্ধ রেখে তাঁর শেষযাত্রায় সামিল হল শোকস্তব্ধ পটৌডি।
আর কে নেই সেই ভিড়ে? নব্বইয়ের বৃদ্ধ থেকে ষোড়শী কিশোরী! কাজে না-যাওয়া অটোওয়ালা থেকে বাচ্চা কোলে গৃহবধূ। সকলেই শরিক হতে চেয়েছে নবাবের শেষযাত্রার।
হবে না-ই বা কেন? |
বৃদ্ধ গোকুল শাস্ত্রী বলছিলেন, “নবাব পরিবার আনন্দ ভাগ করে নিতেন আমাদের সঙ্গে। ওঁদের দুঃসময়ে আমরা কী করে পিছিয়ে থাকি?” সজল চোখে নবাবের ‘শাদি’র স্মৃতিও রোমন্থন
করেন বৃদ্ধ “বাহান্নটা গ্রামের লোককে এক সঙ্গে খাইয়েছিলেন! তার উপরে সকলের বাড়ির জন্য বাক্স-বাক্স মিষ্টি বিলিয়েছিলেন নবাব। নিজের হাতে! বড় ভাল লোক ছিলেন।” খেই ধরিয়ে পাশে দাঁড়ানো নাজিব হুসেনের মন্তব্য, “শুধু কি তা-ই? বেগমকে নিয়ে এখানে আসতেন যখন, তখন নবাবযেন মাটির মানুষ! বাচ্চাদের সঙ্গে হাভেলির বাগানেক্রিকেট আর হকি খেলতেন। মনে হতো, আমাদেরই এক ভাই।”
সেই ‘ভাইকে’ শেষ দেখা দেখতে ‘দ্য পটৌডি প্যালেসে’র সামনে জড়ো হওয়া হাজার পনেরো গ্রামবাসীকে সামলাতে বিরাট পুলিশবাহিনীকে আজ রীতিমতো হিমসিম খেতে হল। অ্যাম্বুল্যান্স থেকে মনসুর আলি খান পটৌডির দেহ নামানো মাত্র চার দিকে তুমুল বিশৃঙ্খলা। মরদেহ অতিকষ্টে ভিড় ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রাসাদের হলে। শর্মিলা, স্যাফ, সোহা, করিনা, করিশ্মার মতো একঝাঁক বলিউডি তারকাকে কাছ থেকে দেখারও তাগিদও কম ছিল না আমজনতার। যা বাগে আনতে পুলিশকে ক’বার মৃদু লাঠিচার্জও করতে হল। দেহ রাখা হয়েছিল যেখানে, ভিড়ের চাপে সেই হলের কয়েকটি পেন্টিং দেওয়াল থেকে খসে পড়ল। ভাঙল কয়েকটা জানলার কাচও।
গত কালই পটৌডির পরিবারের তরফে ঠিক হয়ে গিয়েছিল, প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের মরদেহ ভোর সাড়ে পাঁচটায় হাসপাতাল থেকে বার করা হবে। সেইমতো সেফ আলিরা ভোরে দেহ অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে বসন্তবিহারের বাড়িতে নিয়ে যান। স্বামীর দেহকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়েন শর্মিলা। মাকে কাঁদতে দেখে অশ্রু বাঁধ ভাঙে এতক্ষণ কান্না চেপে রাখা স্যাফের। দুই বোন সোহা-সাবাও ভেঙে পড়েন। স্যাফের বান্ধবী করিনা কপূরের চোখেও তখন জল।
বেলা একটু বাড়তেই ভিড় জমাতে থাকেন ক্রিকেটারেরা। আসেন সস্ত্রীক কপিল দেব ও অজয় জাডেজা। একে একে হাজির হন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংহ, অহমেদ পটেল, মোতিলাল ভোরা, বিজেপি’র অরুণ জেটলি, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, আইপিএল কমিশনার রাজীব শুক্ল, প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট আইএস বিন্দ্রা এবং পাক রাষ্ট্রদূত সইদ মালিক।
বেলা সাড়ে দশটা। |
বসন্তবিহারের বাড়ি ছেড়ে টাইগারকে নিয়ে শবদেহবাহী শকট রওনা দিল হরিয়ানার পৈতৃক গ্রাম পটৌডির উদ্দেশে। স্যাফ বাবার মরদেহের পাশে। পিছনে তিনটে গাড়িতে শর্মিলা, সোহা, সাবা, করিনা। ঠিক সাড়ে এগারোটায় শবযাত্রা পৌঁছয় পটৌডির হাভেলিতে। শুরু হয় দর্শনার্থীদের আগমন। সেলিম দুরানি, অংশুমান গায়কোয়াড় এসে শর্মিলা-স্যাফকে সান্ত্বনা দেন। একে একে দেখা করে যান করিশ্মা কপূর, আমজাদ আলি খান। পাক ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শাহরিয়ার খানও আসেন। দুপুর দেড়টা নাগাদ প্রয়াত নবাবের জন্য জুম্মার শেষ নমাজ পড়া হয় ওই হলে।
বিকেল পৌনে তিনটে। পটৌডির শেষ নবাবের দেহ জনাজায় চাপিয়ে রওনা করা হয়। স্যাফ-সহ পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের কাঁধে-কাঁধে এগিয়ে চলে জনাজা। পঁচিশ একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে থাকা পটৌডির বিশাল প্রাসাদের চৌহদ্দিতে রয়েছে মনসুর আলির বাবা ইফতিকার আলি খান ও মায়ের কবর। দশ মিনিটের যাত্রা শেষে জনাজা গিয়ে পৌঁছয় ওই দুই কবরের সামনে। ঘড়িতে তখন ঠিক ২টো বেজে ৫৫ মিনিট।
পাঁচ মিনিট নমাজ পড়লেন মৌলবি। নবাব পটৌডির দেহ জনাজা থেকে নামিয়ে আস্তে আস্তে শুইয়ে দেওয়া হল নতুন খোঁড়া কবরে। অশ্রুসজল চোখে তার উপরে মাটি ছড়ালেন স্যাফ। মাটি ছড়ালেন আরও অনেকে। প্রাসাদের ছাদ থেকে তখন দাঁড়িয়ে দেখছেন শর্মিলা। পাশে দুই মেয়ে। করিনা। পরে এসে দাঁড়ালেন করিশ্মাও।
কবরে মাটি চাপিয়ে মিছিল ফিরে চলল হাভেলির দিকে।
অবসান হল টাইগার-যুগের। |