কথা ছিল, স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণ মোকাবিলার উপায় বার করতে কমিটি তৈরি হবে। এবং চলতি মাসেই কমিটি রিপোর্ট জমা দেবে।
কিন্তু রিপোর্ট তো দূর, কমিটিটাই এখনও গড়েই উঠতে পারল না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ!
অথচ রাজ্যে নতুন সরকারের পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে সুদর্শন ঘোষদস্তিদার যে কাজটা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে চেয়েছেন, তা হল: স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণের কবল থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়া। গত সাত বছর বিভিন্ন কারখানা বন্ধের নোটিস দিয়ে, জরিমানা করে, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি আদায় করেও যা করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে নতুন পরিবেশমন্ত্রীর উদ্যোগ ভুক্তভোগীদের মনে আশার সঞ্চার করলেও তা এখন প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে।
ওঁদের হতাশার বড় কারণ, গত চার মাস যাবত অভিযুক্ত কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে। যার অন্যতম উদাহরণ, খোদ মন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও স্পঞ্জ আয়রনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কমিটি তৈরি না-হওয়া।
দূষণের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত মাসের গোড়ায় এক রাতে পরিবেশমন্ত্রী নিজেই দফতরের সচিবকে সঙ্গে নিয়ে বড়জোড়ায় কিছু কারখানায় হানা দেন। দেখেন, দু’টো কারখায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র না-চালিয়ে স্রেফ বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে কালো বিষ-ধোঁয়া দেদার বেরিয়ে আচ্ছন্ন করছে চারদিক। দেখে কী করেছিলেন মন্ত্রী?
মন্ত্রী অবশ্য কারখানা বন্ধ করতে বলেননি। জরিমানাও করেননি। বরং তিনি চেয়েছেন দীর্ঘমেয়াদি কিছু ব্যবস্থা নিতে, যাতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়। সুদর্শনবাবুর কথায়, “কেন এ ভাবে দূষণ ছড়ানো হচ্ছে, কারখানা-কর্তৃপক্ষের কাছে তার ব্যাখ্যা চেয়েছি। বলেছি, কারখানার আশপাশে গাছ লাগাতে হবে। আর মাটির তলা থেকে জল না-তুলে বৃষ্টির জল ধরে ব্যবহার করতে হবে। বলেছি, দূষণরোধের সব প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। এ সব না-হলে কারখানা বন্ধের নোটিস দেওয়ার কথা ভাবা হবে।”
বস্তুত মন্ত্রীর এই সব নির্দেশই গত সাত বছর ধরে কার্যকর করার চেষ্টা করেছে পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। কোনও লাভ হয়নি। দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই)’-এর এক সমীক্ষায় প্রকাশ, দূষণ-বিধি অমান্যের দায়ে পর্ষদ চার বছরে পঞ্চাশটি স্পঞ্জ আয়রন কারাখানা বন্ধ করতে অন্তত আড়াইশো নোটিস পাঠিয়েছে। একটাও বন্ধ হয়নি। আরও চমকে ওঠার মতো ঘটনা, রাজ্যের ৯২% স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটর, সংক্ষেপে ইএসপি) মজুত থাকা সত্ত্বেও খরচ কমানোর জন্য সেগুলো অধিকাংশ সময়ে বসিয়ে রাখা হয়! ফলে অধিকাংশ সময়ে তারা প্রচণ্ড হারে দূষণ ছড়ায়।
পরিচালকদের একাংশের এ হেন বেপরোয়া মনোভাবের জেরে পশ্চিমবঙ্গের ৫২% স্পঞ্জ আয়রন কারখানাই দূষণসীমা লঙ্ঘনে অভিযুক্ত। এবং এই দূষণের নিরিখে ঝাড়খণ্ড-ছত্তীসগঢ়-ওড়িশাকে টপকে পশ্চিমবঙ্গই তালিকার শীর্ষে। কিন্তু স্পঞ্জ আয়রনে এত দূষণের কারণ কী?
পরিবেশ-সূত্রের খবর: অধিকাংশ স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় সস্তায় পাওয়া নিকৃষ্ট মানের কাঁচা কয়লা। তাই দূষণ এত বেশি। পরিবেশকর্মীদের আক্ষেপ, উৎপাদন ব্যয় এ ভাবে কমিয়ে কারখানা-মালিকেরা যে চড়া মুনাফা লুটছেন, তার জন্য চড়া মাসুল দিতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। বিষ-ধোঁয়ায় আশপাশের গ্রামের বাতাস দূষিত হয়ে পড়েছে, যার প্রভাবে গ্রামবাসীরা শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও শ্লেষ্মাজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। কালো ধুলোর আস্তরণে ঢেকে যাওয়া ঘাস-বিচালি খেয়ে গরু-ছাগলও আকছার মরছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা। তা ছাড়া স্পঞ্জ আয়রন কারখানা চালাতে প্রচুর জল লাগে। তার প্রায় পুরোটাই তোলা হয় মাটির নীচ থেকে। ফলে আশপাশের সমস্ত কুয়ো, পুকুর, জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে বলে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে।
প্রতিকার কী হতে পারে?
পরিত্যক্ত কয়লাখনি থেকে পাওয়া মিথেন গ্যাস স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারে জোর দিয়েছিলেন সুদর্শনবাবু। রাজ্য সরকার অবশ্য এখনও জানে না, আসানসোলের খনি অঞ্চল থেকে দুর্গাপুর, বাঁকুড়া বা ঝাড়গ্রামের কারখানা পর্যন্ত ওই গ্যাস কী ভাবে আনা হবে। কারণ, পাইপলাইন ছাড়া তা সম্ভব নয়। সুদর্শনবাবুও বলেন, “কোনও কারখানার বয়লার মিথেনে চালাতে গেলে গোটা ব্যবস্থাটাই বদলাতে হবে। দেখতে হবে, সেটা আর্থিক ভাবে বাস্তবসম্মত কি না।”
আর এ সবই দেখার জন্য তিনি ওই কমিটি তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন গত ৩ অগস্ট। কথা ছিল, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট দেবে। অথচ কমিটিই এখনও হয়ে উঠল না কেন?
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কুমার দত্ত বলেন, “শিগগির কমিটির বৈঠক হবে।” কবে হবে?
জবাব মেলেনি। |