উৎসবের আলো
রঙের কোলাজ
হাওড়ায় জঙ্গলমহল। হাওড়াতেই অক্ষরধাম মন্দির। আবার হাওড়াতেই গুপি গায়েন বাঘা বায়েনের গান। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে হাওড়া শহরে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট কোলাজ। যেন গুপি গায়েন বাঘা বায়েনের মতোই তালি বাজিয়ে চলে যাওয়া যাবে ভিন রাজ্যের কোনও মন্দির থেকে এ রাজ্যের কোনও আদিবাসী গ্রামে। মধ্য হাওড়ার পুজোগুলো দেখতে গেলে তাই যেন গোটা দেশেরই পরিক্রমা হয়ে যায়।
যেমন, মধ্য হাওড়ার বেলিলিয়াস লেনের ‘জাতীয় সেবাদল’-এর এ বারের থিম জঙ্গলমহলের গ্রাম। সঙ্কীর্ণ বেলিলিয়াস লেনের ভিতর ঢুকলেই মনে হবে যেন চলে এসেছেন জঙ্গলমহলের কোনও গ্রামে। আপনাকে অভ্যর্থনার জন্য তির-ধুনক হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে আদিবাসী মানুষ। লণ্ঠনের আলোয় দেখতে পাবেন আদিবাসীরা নাচ-গান করছেন। থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকছে প্রতিমা।
‘সরস্বতী ক্লাব’-এর পুজোমণ্ডপ সেজে উঠেছে জল সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। পৃথিবীতে পানীয় জল ক্রমশই কমে আসছে। অথচ, পানীয় জলের অপচয় হয়ে চলেছে বিস্তর। জল কী ভাবে সংরক্ষণ করা যায় তারই দিশা দেখানোর চেষ্টা হবে পুজোমণ্ডপে। ওই এলাকার ‘অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতি’র পুজোয় পুরোমাত্রায় সাবেকিয়ানা বজায় থাকছে।
বিভিন্ন রঙের ছাতা দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করছে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রক লাইনস অ্যাসোসিয়েশন’। জগন্নাথের আদলে তৈরি দুর্গাপ্রতিমা থাকবে ছাতার তলায়। রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মানুষকে ছাতা ব্যবহার করতে হয়। সেই ভাবনাই এ বার কাজে লাগাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ‘কামারডাঙা শীতলাতলা বারোয়ারি’র পুজোমণ্ডপ সেজে উঠবে বাংলার হস্তশিল্পে। মণ্ডপে দশভুজার দশটি রূপের সঙ্গে থাকবে গ্রামবাংলার নিত্য ব্যবহৃত বাঁশের তৈরি নানা জিনিস। থাকবে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি, কুলো, দরমা, ধামসা।
মধ্য হাওড়ার ‘সহযাত্রী’ আয়োজিত তেঁতুলতলা বারোয়ারির ভাবনায় ‘কালো মানুষের দেশে রট আয়রনের বেশে।’ রট আয়রন এখানে কালো মানুষের প্রতীক। কালো মানুষদের জীবনযাত্রাও যে কতটা বর্ণময় হতে পারে তারই কিছুটা হদিস মিলবে হীরকজয়ন্তী বর্ষের এই পুজোমণ্ডপে। এখানে দর্শকদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত থাকবে বীরভূমের আদিবাসী নৃত্য।
‘আরুপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে বাঁকুড়ার একটি গ্রামের আদলে। টেরাকোটার কাজ থাকবে পুজোমণ্ডপের মন্দিরের গায়ে। দেশপ্রাণ শাসমল রোডের ‘পাগলা ফৌজ’-এর থিম আদিবাসীদের নিয়ে। অন্য দিকে, ‘মহেশ পাল লেন পুজো কমিটি’র এ বারের থিম গণেশ বন্দনা। বিভিন্ন রূপে গণেশকে দেখা যাবে মণ্ডপে। শিবপুর ‘কাসুন্দিয়া ইউনাইটেড’-এ প্রতিমায় সাবেকিয়ানার ঐতিহ্য বজায় থাকছে।
মধ্য হাওড়ার শ্রীরূপা সিনেমার কাছে ‘মুক্তিক’-এর পুজোতে ফুটিয়ে তোলা হবে দিল্লির অক্ষরধাম মন্দিরের ময়ূর গেট। ‘রামরাজাতলা যুবকবৃন্দ’র পুজোমণ্ডপও (শঙ্কর মঠে) তৈরি হচ্ছে অক্ষরধাম মন্দিরের অনুকরণে। রামরাজাতলার ‘কল্পতরু স্পোর্টিং’ ক্লাবের ২৮তম বর্ষের থিম ‘পরিবেশবন্ধু’।
‘নেতাজি বালক সঙ্ঘ’র থিম ‘অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভ শক্তির উদয়’। মণ্ডপে এলে দেখা যাবে, এক দিকে কংসের রাজত্ব তো অন্য দিকে কৃষ্ণের রাজত্ব। কোনটা শুভ আর কোনটা অশুভ তা দর্শকেরা নিজেরাই বুঝতে পারবেন। ‘কোড়ার বাগান বারোয়ারি ও বাগবাদিনী ব্যায়াম সমিতি’র ভাবনায় ‘মহাশক্তির ভিন্ন রূপ’। কদমতলার ‘চিত্তরঞ্জন স্মৃতি মন্দির’ পুজো কমিটির ভাবনায় ‘সবুজায়ন ও আয়ুর্বেদ’। মণ্ডপে দেখা যাবে বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ থেকে কী ভাবে ওষুধ তৈরি হচ্ছে। রোগ সারাতে কোন গাছের কী গুণ রয়েছে তা-ও জানতে পারবেন দর্শনার্থীরা। পাশাপাশি, সবুজায়নের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হবে মণ্ডপে।
হাওড়া রামকৃষ্ণপুর লেনের ‘তরুণ সমিতি’র এবারের ভাবনা ‘হারিয়ে যাওয়া শৈশব’। শিশুশ্রমিকদের জীবনের করুণ কাহিনি তুলে ধরা হবে এই মণ্ডপে। বেলিলিয়াস রোডের ‘সুবল স্মৃতি সঙ্ঘ’র পুজোর থিম ‘বিপন্ন মানবিকতা’। কী ভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবিকতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আর মানুষ কী ভাবে যান্ত্রিক হয়ে উঠছে তা দেখা যাবে এই মণ্ডপে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ লেনের ‘চারাবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে রাজস্থানের দিলওয়ারা মন্দিরের আদলে। সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে ‘ব্যাঁটরা নবীন সঙ্ঘ’র থিম, ‘চা বাগান’। পুরো মণ্ডপটিই তৈরি হচ্ছে আসল চা গাছ দিয়ে। পাহাড়ের ধাপে চা বাগানের চড়াই-উতরাই পথ ধরে পৌঁছতে হবে মন্দিরে। পিঠে ঝুড়ি নিয়ে চা পাতা তুলতে দেখা যাবে মহিলাদের।
‘হাওড়া অনুশীলন সমিতি’র ভাবনায় ‘সবুজ বাঁচাও’। গম্বুজ আকৃতির পুরো মণ্ডপটিই তৈরি হচ্ছে সবুজ ঘাস দিয়ে। মণ্ডপের ভিতরে থাকছে একটি জলাশয় ও গাছপালা। হাওড়ায় এক টুকরো শান্তিনিকেতনের ছোঁয়া মিলবে নেতাজি সুভাষ রোডের ‘হাওড়া ব্যায়াম সমিতি’র পুজোমণ্ডপে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষকে মনে রেখেই এই আয়োজন বলে জানালেন পুজোর কর্মকর্তারা।
আবার ‘শানপুর শ্যামা সঙ্ঘ’র পুজোমণ্ডপে এলে গুপি-বাঘার দেশের সন্ধান পাওয়া যাবে। গুপি গায়েন বাঘা বায়েন ছবির নানা দৃশ্য মাটির মডেলের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হবে। ভুতের রাজার সঙ্গে গুপি-বাঘার দেখা হওয়া থেকে শুরু করে ওই ছবির নানা চরিত্রের সঙ্গে মোলাকাত হবে এই মণ্ডপে এলে। অন্য দিকে, ‘উত্তর ব্যাঁটরা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র পুজোয় থাকবে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নেপাল সাহা লেনের ‘প্রগতি সঙ্ঘ’র পুজো সাবেক। নবমীর দিন হয় অন্নকূট উৎসব।
শিবপুরের নীলরতন মুখার্জি রোডের ‘সম্মিলিত নাগরিকবৃন্দ’র মণ্ডপে এলে নাগা এবং সাঁওতাল উপজাতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাবে। তাঁদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন দর্শকরা। ‘কাসুন্দিয়া শিবতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের আদলে। ‘ওলাবিবিতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র ৬৪তম বর্ষের থিম ‘আলো’।
স্বামী বিবেকান্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষকে মনে রেখে এ বার বালিটিকুরির ‘সদানন্দ স্মৃতি সঙ্ঘ দুর্গাপুজো কমিটি’র পুজামণ্ডপ তৈরি হচ্ছে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রকের আদলে। তৈরি হবে স্বামীজীর জীবনী সম্বলিত নানা মডেল। ‘হাওড়া রামকৃষ্ণ অ্যাথলেটিক ক্লাব’-এর পুজোমণ্ডপ জুড়ে গ্রামবাংলার পরিবেশ। মণ্ডপের আলোকসজ্জায় থাকছে প্রদীপের আলো। পুরুলিয়ার ছো নাচের উপর ভিত্তি করে মণ্ডপ তৈরি করছে ‘কদমতলা অবসর সম্মিলনী’। উদ্যোক্তাদের কথায়, শিল্পীদের একটি গ্রাম এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। থাকবে ছো নাচও। ছো-এর মুখোশের আদলে তৈরি হবে প্রতিমার মুখ।


ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.