প্রস্তাব পেশ আব্বাসের
প্যালেস্তাইন সদস্য হবে কি, উত্তেজনা রাষ্ট্রপুঞ্জে
কালীপুজোর মতো বাজি ফাটছে চার দিকে, আলোর রোশনাই। প্রবল ভিড়ে হঠাৎ ধাক্কা খেলাম। মুখ তুলে তাকাতেই দেখি জলপাই রঙের পোশাক পরা, মাথায় সেই চিরপরিচিত রুমালটি। ইয়াসের আরাফত।
নব্বই সালের মে মাসের নামিবিয়ায় মধ্যরাত্রের স্বাধীনতা উৎসব। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর রাজীব গাঁধী বিরোধী দলনেতা। সেদিন দেখেছিলাম, নামিবিয়ার স্বাধীনতার আনন্দে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে হাত ধরে নাচছেন আরাফত।
এর পর তাঁকে বারবার দেখেছি হাডসন নদীর তীরে রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সদর দফতরে। এক প্রবল পরাক্রান্ত যোদ্ধা। সেই কবে থেকে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। আজ তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পরে সেই পৃথক প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণসভায় পেশ করলেন আজকের প্রেসিডেন্ট মেহমুদ আব্বাস।
যদি প্যালেস্তাইন পৃথক রাষ্ট্রের দাবি নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে আসত, তা হলে স্থায়ী-অস্থায়ী সদস্য মিলে ১৫টি ভোটের মধ্যে প্যালেস্তাইনের ন’টি ভোট দরকার হত। কিন্তু আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছিল, প্রয়োজনে তারা ভেটো প্রয়োগ করবে। যদিও শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ভেটো এড়াতেই চাইছিল। বরং প্যালেস্তাইনের প্রস্তাবে সায় না দেওয়ার জন্য অন্য রাষ্ট্রগুলিকে বুঝিয়ে যাচ্ছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আব্বাস নিরাপত্তা পরিষদে না গিয়ে প্রস্তাবটি সাধারণসভায় নিয়ে এলেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুনের হাতে প্রস্তাবপত্রটি তুলে দিয়ে নিজের বক্তৃতায় বললেন, “আমরা রাষ্ট্রপুঞ্জে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা নিতে আগ্রহী যাতে সার্বিক শান্তি এবং প্যালেস্তিনীয় জনসাধারণের বৈধ জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা যায়।” কিছুক্ষণ পরেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বক্তৃতা দিতে উঠবেন। সেখানে তিনি আব্বাসের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করবেন বলে ধরে নেওয়াই যায়।
সাধারণসভায় পৃথক রাষ্ট্রের এই দাবিপত্র জমা দিয়ে আব্বাস কি আরাফতের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন? তেমন আশা কিন্তু কেউই করছেন না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত পৃথক প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের পক্ষে। ১৯৮৮ সাল থেকেই ভারত প্যালেস্তাইনকে এই সমর্থন জানিয়ে আসছে। সুতরাং আমেরিকার কাছেও এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়। প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার স্থায়ী সদস্য করা নিয়ে আব্বাসের যতটা উৎসাহ, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে মনমোহনের উৎসাহও তার থেকে কিছু কম নয়। এ ব্যাপারে তিনি আমেরিকার অনুগ্রহ-প্রার্থীও বটে। কিন্তু তাই বলে প্যালেস্তাইন থেকে ইরান, এমনকী সিরিয়া-লিবিয়া নিয়ে আমেরিকার পশ্চিম এশিয়া নীতির সমালোচনা করতে ছাড়ছে না ভারত। মনমোহন বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আমেরিকার বন্ধু তিনি হতে পারেন। কিন্তু ভারত ‘জো হুজুর’ বিদেশনীতি নিয়ে চলে না। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের ভাষায়, “হ্যাঁ-তে হ্যাঁ বলাটাই কূটনীতি নয়। আমরা ন্যাটোর সদস্য নই। বিভিন্ন মতপার্থক্য নিয়েই আমাদের অংশীদারিত্ব। তাতে আমেরিকাকেও অভ্যস্ত হতে হবে।” কাল ইরানের প্রেসিডেন্ট যখন বক্তৃতা দিতে উঠলেন, তখন আমেরিকার কূটনীতিকরা সভাকক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। সেখানে মনমোহন কিন্তু আজ ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারলেন রাষ্ট্রপুঞ্জেরই দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকক্ষে।
প্যালেস্তাইন নিয়ে সাধারণসভায় তর্কবিতর্ক যতই হোক, আব্বাস যতই সমর্থন জোগাড় করুন, রাষ্ট্রপুঞ্জে পৃথক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং স্থায়ী সদস্যপদ পেতে হলে বিষয়টিকে নিরাপত্তা পরিষদে তুলতেই হবে। সেখানে ভেটো দেবে আমেরিকা। তবে প্যালেস্তাইন বর্তমানে যে ‘অবজার্ভার এনটিটি’-র মর্যাদা পায়, সাধারণসভা তাকে উন্নীত করার জন্য ভোট দিতে পারে। তার থেকে তাকে ভ্যাটিকানের মতো ‘অবজার্ভার স্টেট’-এ উন্নীত করা হতে পারে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি তেমন একটা ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছেন।
শেষ পর্যন্ত এমনও হতে পারে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ নিয়ে যেমন এই সফরে কিছুই হবে না, তেমন প্যালেস্তাইনের বিষয়টিও ঝুলিয়ে রাখা হবে। কারণ ইজরায়েল এ বিষয়ে প্রবল চাপ তৈরি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বৃহস্পতিবার তাঁর বক্তৃতায় রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূমিকা নিয়ে কিঞ্চিৎ কটাক্ষই করেছেন। তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রস্তাব এনে শান্তি স্থাপন করা যাবে না। ব্যাপারটা এতই সহজ বলে অনেক দিন আগেই সেটা হয়ে যেত।” বক্তৃতার আগের দিন, বুধবার ওবামা এমনকী আব্বাসের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন। সেখানে ওবামা বলেছেন, প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রগঠন নিয়ে আমেরিকার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ইজরায়েলের সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফা ভাবে কিছু করা চলবে না।
রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশন মানেই নানান ভাষার সাংবাদিকরা কফিহাউসে বসে কফির পেয়ালায় তুফান তোলেন। আলোচনায় কখনও আসে প্যালেস্তাইন, কখনও কিউবা, কখনও তিব্বত। রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরের সামনে নির্ধারিত জায়গায় পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। কখনও সেখানে ম্যান্ডেলা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, কখনও আরাফত, কখনও কাস্ত্রো, কখনও ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজ। এখন আবার ইরানের আহমেদিনেজাদ এবং ধূসর কেশ ও চকচকে জুতোর মেহমুদ আব্বাস। নিউ ইয়র্কের মধ্যে থেকেও এ যেন এক আলাদা জগৎ। যার সঙ্গে দিল্লির যন্তর মন্তর বা কলকাতার এসপ্ল্যানেড ইস্টের মিলই বেশি। কী বলা যাবে একে? গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা?
কিন্তু রামাল্লা আর জেরুজালেমে টিভির পর্দার সামনে জড়ো হয়েছেন যে লক্ষ লক্ষ মানুষ, তাঁদের কাছে অবশ্য এটা খেলা নয়। পশ্চিম এশিয়ার মার্কিন দূতাবাসগুলি তো বটেই, খাস নিউ ইয়র্কেও বড় মাপের বিক্ষোভ হতে পারে বলে তৈরি প্রশাসন। পরিস্থতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সেটাই খেয়াল রাখছে তারা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.