পূর্বের পাহাড়ে কাঁপুনি আতঙ্ক ধরিয়ে দিল অর্ধেক দেশ জুড়ে।
রবিবার তখন সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট। আচমকা পায়ের তলায় দুলে উঠল মাটি। সিকিম থেকে শুরু হয়ে সেই কম্পন ছড়িয়ে পড়ল দার্জিলিং পাহাড় হয়ে গোটা রাজ্যে। কলকাতাতেও। বাদ গেল না উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশাও। ভারতীয় আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্যাংটক থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে সিকিম -নেপাল সীমান্তের মঙ্গন এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ৬ .৮। প্রথম এই ধাক্কার পরেও সিকিম চলতে থাকে পরের পর কম্পন। সেই সব ‘আফটার শক’-এর মধ্যে রিখটার স্কেলে সর্বোচ্চ দু’টির তীব্রতা ছিল ৬ .১ এবং ৫ .৩।
শুধু পূর্ব, উত্তর -পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর ভারতের বড় অংশই নয়, এই ভূমিকম্পের প্রবল ধাক্কায় কেঁপেছে প্রতিবেশী দেশ নেপাল এবং বাংলাদেশও। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। জখম শতাধিক। এর মধ্যে সিকিমে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচ জন, উত্তরবঙ্গে তিন জন এবং বিহারে দু’জন। এ ছাড়াও নেপালে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উত্তর সিকিম। বহু এলাকায় ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, হোটেলও। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত। ভূমিকম্পের পরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় সিকিমে। বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সব মোবাইল পরিষেবা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যোগাযোগ করা যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, অন্ধকার নেমে আসায় উদ্ধারে যাওয়াও বহু ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, মৃতের সংখ্যা পরে আরও বাড়তে পারে। |
ভয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন লোকজন। রবিবার সন্ধ্যায়
ভূমিকম্পের পরে। পটনায়। ছবি: পি টি আই |
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ভূমিকম্পের ধাক্কায় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রবিবার বলে এ দিন জোরকদমে চলছিল পুজোর বাজারও। ভূমিকম্পের আতঙ্কে কলকাতার বহু শপিং মল থেকেই হুড়োহুড়ি করে লোকজন বাইরে বেরিয়ে আসেন। তবে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়েছে উত্তরবঙ্গ। দার্জিলিঙে ধস নামছে। দার্জিলিং ও কালিম্পঙের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শিলিগুড়ির একটি এলাকায় পাঁচিল ধসে, সিঁড়ি থেকে পড়ে এবং রাস্তায় পড়ে গিয়ে আহত হন অন্তত তিনশো জন। এঁদের মধ্যে ৭৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের পাহাড় ও সমতলে জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ। জলপাইগুড়ি শহরের অন্তত দেড়শো বাড়ি ভেঙে পড়েছে। দার্জিলিঙের জেলাশাসককে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে খোঁজখবর করে বিস্তারিত জানাতে বলা হয়েছে। মহাকরণে একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়।
ঘটনার পরেই নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অবিলম্বে বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের বৈঠক ডাকেন। সনিয়া গাঁধীও খোঁজখবর নেন। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবনকুমার চামলিংও মন্ত্রিসভার সদস্য ও প্রশাসনিক কর্তাদের জরুরি বৈঠকে ডেকেছেন। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার পাঁচশো জনকে বায়ুসেনার পাঁচটি বিমানে চাপিয়ে দিল্লি থেকে বাগডোগরা পাঠানো হয়। কলকাতা থেকেও গিয়েছে একটি দল। এ ছাড়াও আলাদা চিকিৎসক -দল পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। দার্জিলিঙের জেলাশাসককে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি যেন এঁদের সকলকে বাগডোগরা থেকে সঙ্গে সঙ্গে সিকিমে পাঠানোর ব্যবস্থা করে রাখেন। সিকিম প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, সিকিম সচিবালয়ের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আতঙ্কে ঘর ছেড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছেন। পর্যটকদের আপাতত গ্যাংটকের পালজোর স্টেডিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আবার বহু লোককে বিধানসভা ভবনেও আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। শুধু গ্যাংটক শহর থেকেই দু’টি বড় ধসের খবর মিলেছে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত নানং এবং ৩১এ নং জাতীয় সড়ক।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঘটনার পরেই বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য সব রকমের ব্যবস্থার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান এবং রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে। তিনি বলেন, “একটা ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু এখনই অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো কারও হাতে থাকে না ! সকলে মিলে একসঙ্গে বিপন্ন মানুষকে দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। মানুষকেও সতর্ক থাকতে হবে। আর ভূকম্প টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী জানান, সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে। কন্ট্রোল রুম এবং হেল্পলাইন খোলা হয়েছে। কোথাও কেউ বিপদে পড়ে থাকলে বা আটকে থাকলে দ্রুত উদ্ধার করা হবে। ভূমিকম্পের জন্য বিদ্যুৎবিভ্রাটও হয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের রাজ্যের তিন জেলা দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে কম্পন বেশি করে টের পাওয়া গিয়েছে। দার্জিলিংয়ের জেলাশাসক বেরিয়ে পড়েছেন। বিদ্যুৎ দফতর, বিপর্যয় মোকাবিলা ও দমকল বিভাগ সকলেই তৈরি আছে।”
|
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। বিপদের দিনে বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে তাঁদের সব রকমের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে আজ রাতের ট্রেনেই দার্জিলিং চলে যেতে বলেছি। গৌতম দেবকেও পাঠিয়ে দিচ্ছি। পরে তেমন কিছু হলে আমি নিজেও যাব। নেপালেও অনেকে মারা গিয়েছেন। ভূমিকম্প হলে অনেক সময় জলোচ্ছ্বাস বেশি হয়। তবে কলকাতায় এবং তার আশেপাশে আর ভয় নেই। সকলে সকলের উপরে নজর রাখুন। অঘটন ঘটলে সকলে সকলের সাহায্যে এগিয়ে আসুন।”
পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি মোর্চা নেতা হরকা বাহাদুর ছেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ভূকম্পের পরেই ফরাক্কার এনটিপিসি -র ৫০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায়, রঙ্গিত, চুখা ও তিস্তার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এনটিপিসি -র কহেলগাঁও ২১০ মেগাওয়াটের ইউনিটটিও বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে উত্তরবঙ্গ ও বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ বিহীন হয়ে পড়ে।
রেল সূত্রের খবর, ঘটনার পরে উত্তরবঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় ট্রেন। রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না তা দেখার কাজে নেমে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীরা।
দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি রয়েছেন ভুটানের একটি হোটেলে। কম্পনের পরে তিনি জানান, ওই হোটেলের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরা পড়েছে। ভূমিকম্প হওয়ার সময় ভাইচুং ভুটিয়া সহ সিকিম ইউনাইটেডের তারকা ফুটবলাররা ছিলেন সিকিমে। ভাইচুং গিয়েছিলেন গ্যাংটক থেকে দূরে, তাঁর বাড়ির কাছে। বার তিনেক ভূমিকম্পের পরে মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সব ফুটবলারের। পরে জানা যায়, ফুটবলাররা সবাই সুস্থ। তবে তাঁদের বাড়ির কাছে পথে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে।
|
অসমের ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকায় তীব্র কম্পন অনুভূত হয়েছে। একই অবস্থা হয় মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচলে। কম্পনমাত্রা এখানেও ৬ .৮। কম্পন ও ‘আফটার শক’ মিলিয়ে স্থায়িত্ব ছিল এক মিনিটের বেশি। ভূকম্পের ফলে গুয়াহাটির বেশ কয়েকটি বাড়ি ও আবাসনে ফাটল ধরার খবর এসেছে। বাড়ি ভেঙে পড়ে গোলাঘাটের কামারগাঁওতে। ধুবুরিতে দেওয়াল ধসে জখম হন এক মহিলা। অনেক অঞ্চলেই চলে যায় বিদ্যুৎসংযোগ। অসম ও মেঘালয়ে ভূমিকম্পের পরে প্রায় ঘণ্টাখানেক মোবাইল পরিষেবা ব্যহত হয়। অবশ্য পরের কম্পনদু’টিতে তেমন আতঙ্ক ছড়ায়নি। ক্ষতিও হয়নি। |