একটা শটেই গোটা গল্প, বাংলাতেও
বাড়ছে ‘ইন্ডি’ ছবির পরীক্ষা
ক ঘণ্টা চুয়াল্লিশ মিনিটের ছবি। পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র। কিন্তু কোনও চিত্রসম্পাদক নেই।
কেন? কারণ, ছবিতে সম্পাদনার কোনও কাজই নেই। গোটা ছবিতে একটি মাত্র শট।
আলেকজান্ডার সকুরভের বিখ্যাত ছবি ‘রাশিয়ান আর্ক’-এর কথা মনে পড়তে পারে। ৯৬ মিনিটের সেই ‘পিরিয়ড পিস’ও তোলা হয়েছিল একটি শটে। উরুগুয়ের পরিচালক গুস্তাভো হারনান্ডেজ-এর ‘দ্য সাইলেন্ট হাউস’ ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ৭৯ মিনিট লম্বা একটি মাত্র শটে। সেই পরীক্ষানিরীক্ষারই একটি বঙ্গীয় সংস্করণ সম্প্রতি শু্যট করা হল কলকাতায়। ‘রতিচক্রব্যূহ’ নামে এই ছবির পরিচালক আশিস অভিকুন্তক পেশায় শিক্ষক। আমেরিকার রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক তিনি।
এর আগে আশিসের ছবি ‘নিরাকার ছায়া’ লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল। জিতেছিল একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। আশিসের নতুন বাংলা ছবি একাধারে দু’টি সম্ভাবনার দিগন্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটি হল, ডিজিটাল মাধ্যমে চলচ্চিত্র ভাষা নিয়ে পরীক্ষার সুযোগ। দুই, স্বাধীন (ইন্ডি) চলচ্চিত্রের বিকাশ। বিশেষত বাংলায় স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচালক ‘কিউ’ সম্প্রতি যে ধরনের সাফল্য পেয়েছেন, তার পরে ইন্টারনেট এবং নানা ধরনের গ্যালারির মাধ্যমে ছবি দেখানোর রেওয়াজ জনপ্রিয় হচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে নানা ধরনের চলচ্চিত্র উৎসব এবং ফিল্ম মার্কেট তো আছেই। আশিসের মতো পরিচালকরা এই ‘ভিন্ন’ পরিসরগুলো ব্যবহার করতে আগ্রহী।
স্বাধীন বা ‘ইন্ডি’ চলচ্চিত্র মানে কী? আশিসের ব্যাখ্যায়, চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে তৈরি যে কোনও ছবিকেই ‘ইন্ডি’ ছবি বলা যেতে পারে। হলিউডে ‘ইন্ডি’ ছবির উত্থান হয়েছিল বড় স্টুডিওগুলোর বাইরে বেরিয়ে এসে। এ দেশেও তথাকথিত ‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি’র বাইরে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রযোজনা সংস্থাগুলির সাহায্য না নিয়ে, ইন্ডাস্ট্রির পরিকাঠামো ব্যবহার না স্বাধীন ভাবে ছবি করার যা কিছু উদ্যোগ, তাকেই ‘স্বাধীন’ বা ‘ইন্ডি’ ফিল্ম বলা যায়। এই অর্থে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ‘ইন্ডি’ ছবিরই নিশান। বিশ্ব সিনেমায় রে আব্রাশকিন, অ্যান্ডি ওয়ারহল থেকে আজকের জিম জারমুশ, কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো বা স্টিভেন সডারবার্গের মতো পরিচালকরা একের পর এক ‘ইন্ডি’ ছবি উপহার দিয়েছেন। সে সব ছবি দশর্ক-সমালোচক সকলকেই চমকে দিয়েছে। এই মুহূর্তে পৃথিবী জুড়ে একগুচ্ছ উৎসব শুধু ‘ইন্ডি’ ছবিই দেখায়। হলিউডের বড় স্টুডিওগুলো আজকাল বড় বাজেটের ছবির পাশাপাশি ‘ইন্ডি’-মেজাজের ছবির জন্যও আলাদা ব্যবস্থা রাখে।
‘রতিচক্রব্যূহ’ শু্যটিংয়ের ছবি। আশিস অভিকুন্তকের সৌজন্যে
এই নিরিখে বাংলা ছবি কোথায় দাঁড়িয়ে? সাম্প্রতিক কালে সাড়া ফেলে দেওয়া পরিচালক ‘কিউ’ বললেন, ‘‘‘ইন্ডি’ ছবির পরিসর অবশ্যই বাড়ছে। অনেক বছর ধরে আমরা এটার জন্য চেষ্টা করে আসছি। কোরিয়া, জাপান বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যদি সেটা সম্ভব হয়, এখানেই বা হবে না কেন? এখন অনলাইনে তথ্যচিত্রেরও বিপণন সম্ভব হচ্ছে। স্বাধীন ভাবে ছবি বানানো আর দেখানোর সুযোগ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলেই মনে করি।” ‘ইন্ডি’ ছবির সাফল্য নিয়ে একই রকম আশাবাদী পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও। সৃজিত বললেন, “এখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যেও মননশীল ছবি করা যাচ্ছে এবং সে সব ছবি দর্শক দেখছেন, এটা যেমন ভাল খবর। তেমনই ‘ইন্ডি’ ছবির পরিসরটাও যে ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করছে, বাংলা ছবির জন্য সেটা খুবই আশার কথা। কিউ-এর ছবি বার্লিনে, মৈনাক বিশ্বাস-অর্জুন গৌরিসারিয়ার ‘স্থানীয় সংবাদ’ নিউ ইয়র্কে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র উৎসব, নানা রকম পুরস্কার এবং মিডিয়া ও ইন্টারনেটের সুবাদে দর্শকের কাছে পৌঁছনোর অনেক রাস্তা খুলে গিয়েছে।” বাংলায় ‘ইন্ডি’ ছবির সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়েই কিউ-এর পরের ছবি ‘তাসের দেশ’-এর সহপ্রযোজনায় এগিয়ে আসছেন অনুরাগ কাশ্যপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোর্টেবল ক্যামেরা আসার পরে স্বাধীন ভাবে ছবি করার রাস্তা অনেক প্রশস্ত হয়েছিল। ঠিক তেমনই ডিজিটাল ক্যামেরার আবির্ভাবও সেই ভূমিকাটাই নিচ্ছে ইদানীং। এক দিকে কমছে ছবি তৈরির খরচ, মূলস্রোতের ছবিতেও ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল ক্যামেরা। অন্য দিকে বাড়ছে, নানা ধরনের পরীক্ষার সুযোগ। কী রকম? আশিস জানাচ্ছেন, রাশিয়ান আর্ক, দ্য সাইলেন্ট হাউস বা রতিচক্রব্যূহের মতো ‘ওয়ান শট ফিল্ম’ তৈরি হতে পারছে শুধুমাত্র ডিজিটাল মাধ্যমের জন্যই। আজকের দিনে এখানকার ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরায় একটি রোলে একটানা সাড়ে চার মিনিট শু্যট করা সম্ভব। কিন্তু ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় টানা ১০ মিনিট। ডিজিটাল ক্যামেরা সেই বাধাটা ভেঙে দিয়েছে।
ফলাফল? আশিসের ছবিতে ১৩টি চরিত্র গোল হয়ে বসে একাঙ্ক নাটকের মতো একটানা অভিনয় করে চলে, শুরু থেকে শেষ। আর তাদের ঘিরে ক্যামেরা চক্কর কেটে চলে ঘড়ির কাঁটার মতো। চিত্রগ্রাহক বাসব মল্লিক বললেন, “খুবই অভিনব অভিজ্ঞতা। সামনে প্রায় কোনও মডেল নেই। ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ছবি তোলার প্রশিক্ষণ বা ছবি দেখার অভিজ্ঞতা কোথাওই এই জাতীয় ছবির জন্য প্রস্তুতি কী ভাবে নেওয়া উচিত, তা শেখায়নি। রীতিমতো নার্ভাস লাগছিল। কাজটা শুরু হয়ে যাওয়ার পর দেখলাম, শারীরিক পরিশ্রমটা সমস্যা নয়। একটানা নিরবচ্ছিন্ন মনঃসংযোগটাই বড় কথা। আর সেটা করতে গিয়ে দেখলাম, চিত্রগ্রাহক নিজেই কখন দর্শক হয়ে গিয়েছে। সে শুধু ছবি তুলছে না, ঘটমানতার অংশ হয়ে যাচ্ছে।”
আর সেই জন্যই আদতে পঞ্জাবি, তবে কলকাতায় বড় হওয়া আশিস বলেন, “কলকাতা ছাড়া ছবি করার কথা ভাবিই না। ছবি করতে আমায় কলকাতাতেই আসতে হয়।”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.