কী যন্তর ছেলে
যন্ত্রমানব
সূর্য ডুবু ডুবু। আর এক পা এগোলেই পাহাড়ের ফাঁক গলে পড়ে যাবে, আর তখনই নেমে আসবে নিকষ কালো অন্ধকার! জেগে উঠবে বন-বাদাড় আর রাক্ষস-খোক্ষস! গুহামানব আর গুহামানবী হাত ধরাধরি করে বাইরে এসে দাঁড়ালেন আর সূর্যদেবকে পেন্নাম ঠুকে বললেন ‘না গেলেই কি নয়? তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ঠাকুর’। ওদিকে পাশের গুহা থেকে লাগাতার ঠকাঠক আওয়াজ। এই পটভূমিকায় যা বাড়তি ভয়ের সঞ্চার করেছে। কিছু ক্ষণ পর সব চুপচাপ। পাশের গুহার মালিক (অথবা ভাড়াটে) বাইরে এসে পাথরের ওপর বসলেন পায়ের ওপর পা তুলে। ওনার দু’হাতে দু’টি ছোট ছোট পাথর। মুখে গাছের পাতা রোল করে বানানো কী এক অদ্ভুত বস্তু। উনি পাথর দু’টি মুখের কাছে এনে খটাখট ঠুকলেন এবং ওই পাতার গায়ে এক ঝলক বিদ্যুৎ ধরা পড়ল। তারপর ভুস্ভুস্ ধোঁয়া। গুহামানবী শিউরে উঠলেন। গুহামানব স্বগতোক্তি করলেন ‘কী যন্তর ছেলে মাইরি!’ ওই যন্তর ছেলের (এবং এক মানবীর) সন্তান-সন্ততিরা লক্ষ লক্ষ বছর পরে লোক পাঠাবে চাঁদে আর ট্রেন চালাবে সমুদ্রের তলা দিয়ে তাতে আর আশ্চর্য কী! সেই প্রস্তর যুগ থেকেই ঠিক হয়ে আছে একদিন পৃথিবীর যত মর্ম মূর্তি প্রাণ পাবে রোবট রূপে, আর তাদের নাম হবে রজনীকান্ত! কাট্
আজকের যন্তর ছেলে টাবলুর রোজনামচা পড়া যাক। ঘুম ভাঙে মোবাইলের অ্যালার্মে (আজকাল সাধারণ অ্যালার্ম ঘড়ি শো-পিস)। রিমোটে এসি বন্ধ করে বিছানা থেকে উঠেই মুখে ব্যাটারিচালিত টুথ ব্রাশ। প্রকৃতির ডাক সেরে টোস্টারে দু’পিস পাঁউরুরি গুঁজে কফি-মেকার অন্। ব্রেকফাস্ট টেবিলে ট্যাবলেট পিসি-তে খবরের কাগজ। দেওয়ালে ডিজিটাল ক্লকের দিকে তাকিয়ে ‘দেরি হয়ে গেল’ বলে উঠে পড়া। ইলেকট্রিক শেভিং যন্ত্র চালিয়ে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি হাপিস। শাওয়ার ক্যাবিনেটে ঠান্ডা-গরম জল মিশিয়ে কাক-স্নান। তবে আগেই মাইক্রোওয়েভে হালকা গরম হয়ে গেছে আগের রাতে ফ্রিজে রাখা লাঞ্চ-বক্স। অফিসের ব্যাগ গুছিয়ে (অবশ্যই ল্যাপটপ) ঝটিতি জামা-প্যান্ট-জুতো-মোজা পরে টাবলু বেরিয়ে পড়ল। দরজা লক করে সুইচ অন করে দিল সিকিউরিটি ক্যামেরার। তারপর লিফটের বোতাম টিপে ডেকে নিল চোদ্দ তলায়। গাড়িতে যেতে যেতে স্মার্টফোন-এ বাকি খবর, দু’-চারটে বিজনেস কল। তারপর কারখানায়। স্টেট অব দি আর্ট যন্ত্রপাতি এসেছে বিদেশ থেকে। পুরনো যন্ত্র ফেলে নতুন যন্ত্রের জায়গা করে দেওয়া টাবলুর সময় নেই নিশ্বাস ফেলার। রাতে বাড়ি ফিরে সোফায় লম্বা টিভি অথবা মিউজিক সিস্টেম। রাত ন’টা নাগাদ প্রেমিকার ফোন আসে, টাবলু বলে ‘আজ খুব টায়ার্ড, ডিয়ার। এস এম এস করো।’ টাবলুর প্রেম এখন একশো ষাট শব্দের টুকরো সংলাপ।
সময়টা তিন দশক পিছিয়ে দিলে আমরা দেখব টাবলুর বাবা ভেবলুকে। আলেকজান্ডার গ্রাহম বেল মার্কা গাম্বাট রিসিভার কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো প্রেম, হ্যালো প্রেম’ বলে যাচ্ছেন অবিরাম আর দর-দর করে ঘাম ঝরছে। আরও পিছিয়ে দিল এই সময় যন্ত্র। ভেবলুর বাবা হাবলু এক শীতের সন্ধ্যায় চাদর মুড়ি দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন। একটা বাড়ির রোয়াকে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে পকেট থেকে একখানা কাগজ ও পাথরের টুকরো বের করলেন। একটু পরেই তিনতলার বারান্দায় ঠক্ করে একটা শব্দ। খড়খড়ি ফাঁক হল আর এক চিলতে এলোচুল দৃশ্যমান। প্রেম আছে প্রেমের জায়গাতেই। নিবেদনের যন্ত্রগুলো বদলেছে শুধু।

যন্ত্রদানব
“যন্ত্র মানুষের শান্ত সরল জীবনে বিরোধী এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হরণ করিতেছে বলিয়া ইহাকে দানবের সহিত উপমিত করা হয়” চলন্তিকা।
কশ্যপপত্নী দনুর পুত্র দানব অথবা অসুরের কথা ভাবলেই ভয়ংকর চেহারা, ঝাঁকড়া চুল, মুলোর মতো দাঁত, লাল চোখ এক চিত্র ফুটে ওঠে। ছোটবেলার যন্ত্রদানব বলতে রোড রোলার কালো বিদঘুটে একটা যন্ত্রে পিচ গলানো হচ্ছে, ঢেলে দেওয়া হচ্ছে রাস্তায় পাথরকুচির ওপর আর একটু দূরে
অপেক্ষমান সাক্ষাৎ অসুর।যারা যন্ত্রসভ্যতার সুবিধা ভোগ করে উঠতে পারেননি এখনও এবং যাদের জন্য বিশ্বকর্মা তৈরি করেননি আকাশচুম্বী অট্টালিকা অর্থাৎ যাঁরা কাঁচা বাড়ির ফুটো চালের নীচে দিন কাটান, তাঁদের কাছে যন্ত্রদানবের সংজ্ঞা হল বুলডোজার! ভাঙার সময় নতুন ঘরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়। ওই ভাঙা ঘরের সংসারের কয়েকটি যন্ত্র মিলেমিশে যায় আমাদের সংসারের সঙ্গে যেমন, পেন্সিল কাটার কল, হাতা, খুন্তি, সাঁড়াশি, কখনও হেয়ার ড্রায়ার এবং কী আশ্চর্য মোবাইল ফোন।
অভিধানের সংজ্ঞায় আর একবার চোখ বুলোলেই ধরা পড়বে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। প্রস্তর যুগ থেকে লৌহ যুগ, স্পেস এজ থেকে ইনফরমেশন এজ এই বৈপরীত্য চিরন্তন। বিশাল ডায়নামো ঘুরছে অক্লান্ত, বয়লারে ফুটছে আগুন, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে অনায়াসে উড়ে যাচ্ছে প্লেন, প্রমোদতরীতে রাত বদলাচ্ছে আলোর পোশাক আর নিরন্তর জিজ্ঞাসা নিয়ে বিশাল রকেট উড়ে যাচ্ছে স্পেস স্টেশনে। অন্য দিকে এই যন্ত্রই ঘুম কাড়ছে, ভাত মারছে মানুষের। একটা বোতাম টিপে হাওয়া করে দেওয়া যায় গোটা একটা দেশ ভাবা যায় না।

যন্ত্রশিল্পী
পৃথিবীতে দু’রকম যন্ত্রশিল্পী আছেন। এক, যাঁরা কিছু বাজান-টাজান; দুই, যাঁরা যন্তর (অর্থাৎ চেম্বার) চালান। সরস্বতী পুজোয় গাঁক-গাঁক করে মাইক বাজছে। এ পাড়ার মাস্তান হোঁৎকার পুজো। ও-পাড়ার মাস্তান ঘোঁৎনা চোঙা মাইকের মধ্যে আস্ত কলাগাছ গুঁজে দিল। ব্যস রণক্ষেত্র। ঘোঁৎনার পকেট থেকে যন্তর বের হল ছ’ঘড়া। তবে মরচে-ধরা। হোঁৎকা বলল, ‘দাঁড়া, আমারটা নিয়ে আসছি।’ এল তুমুল জং-ধরা এক হাত লম্বা ছোরা। ঘোঁৎনা বুঝল গুলি বের না হলে তার যন্তর জগন্নাথ। অতএব পলায়ন। মরচের মাহাত্ম্য বাড়াতে মাইকে সানাই শুরু হল।
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে অবশ্য প্রাণসংশয় নেই। যদিও সব বাদ্যযন্ত্রই যে বাধ্য-যন্ত্র হবে, এ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। কিন্তু সরস্বতীর এই স্টাইল স্টেটমেন্ট-ই সৃষ্টির আদি থেকে আপাতদৃষ্টিতে মরা মানুষকেও বাঁচিয়ে রেখেছে। কঙ্কালীতলার অন্ধ বাউলের দোতারার সঙ্গে প্রতিদিন ঠেকা দিয়ে চলেছে আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাথ আঁকড়ে শুয়ে থাকা ভিখারির খঞ্জনী। আমাদের ছোটবেলার কলকাতায়, বিশেষ করে উত্তর কলকাতায়, সন্ধেবেলা পাড়া-বেড়াতে বেরোলেই শোনা যেত তবলায় তেরে-কেটে, হারমোনিয়ামের প্যাঁ আর পুরুষ গানের মাস্টারের সঙ্গে কোকিল কণ্ঠীর ডুয়েট। এখন শব্দটা অন্য রকম। গিটারের ঝ্যাং-ঝ্যাং, ড্রামসের ধুম-ধামের সঙ্গে কি-বোর্ডের ডিসকর্ড। শিল্প আর শিল্পী আছেন, যন্ত্র বদলেছে মাত্র!

ষড়যন্ত্র
ছোটবেলা থেকে বদ্যিনাথবাবু বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীর সবচেয়ে সাংঘাতিক যন্ত্র হল ষড়যন্ত্র। প্লেন, ট্রেন, জাহাজ, ছুরি, কাঁচি, বন্দুক, নরুণ মায় কান খোঁচানোর যন্ত্র চোখে দেখা যায়। কিন্তু ষড়যন্ত্র নিঃশব্দ ঘাতক! সারা জীবন সাইকেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে রিটায়ারমেন্টের পর সাইকেল সারানোর দোকান দিলেন বদ্যিনাথবাবু। নাম রাখলেন বিশ্বকর্মা সাইকেল ওয়ার্কস (এই নামে সত্যিই কোনও দোকান আছে হয়তো, তবে সেটা অন্য দোকান)। সারা দিন নাট-বল্টু ঘাঁটেন আর সন্ধেবেলা স্ত্রীর সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেন। জীবন এ ভাবেই চলছিল। এক দিন রাতে, প্রবল ঝগড়ার মধ্যে বৈদ্যনাথবাবু খাবি খেয়ে, চোখ উল্টে ঘাটে লম্বা হলেন। ছোট ছেলে ডাক্তারি পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বাপের নাড়ি টিপে জানিয়ে দিল গন্ কেস। তার পর দাদা-দিদিকে ফোন করে খবর দেওয়ার জন্য পাশের ঘরে চলে গেল। বৈদ্যনাথবাবুর স্ত্রী এত ক্ষণ থুম মেরে বসে ছিলেন। এ বার হাঁউমাউ শুরু করলেন ‘ওগো এ কী হল গো’, ‘আমি তো কিছু বলিনি গো’ ইত্যাদি। নিজেকে দোষমুক্ত করে, এ বার বৈদনাথকে সেন্টিমেন্টাল ঝাড়লেন ‘ওগো, তুমি কী করে এমন পাষাণ-হৃদয় হলে গো।’ বৈদ্যনাথের আত্মা উড়ু-উড়ু করছিল। এই কথা শুনে আবার সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেল। উনি খাটের ওপর সোজা হয়ে বসলেন। তার পর গিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে বললেন ‘যে দিন তোমরা যড়যন্ত্র করে আমার বুকে পেস মেকার বসিয়েছ, সে দিন থেকেই আমি পাষাণ-হৃদয়’।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.