ওঁরা এলেন। তবে শুধুই দেখলেন না। কাজ করলেন। ভালবাসা দিলেন। যাওয়ার আগে জয় করলেন আবাসিকদের মন।
ওঁরা কেউ স্থানীয় নন। এমনকী এ দেশেরও নন। জাপানের সাসাকাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। ডাক পেয়ে ওঁরা এসেছিলেন বিষ্ণুপুর স্টেশন লাগোয়া যমুনাবাঁধ লেপ্রসি কলোনিতে। ঝড়-বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া বা অবহেলায় জীর্ণ বাড়ি সংস্কারের কাজে হাত লাগিয়েছেন ওই ছাত্রছাত্রীরা। এক সঙ্গে বসে খেয়েছেন কলোনির আবাসিকদের সঙ্গে। কাজ করেছেন হাতে হাত মিলিয়ে।
প্রায় দু’সপ্তাহ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন ছাত্রছাত্রী কুষ্ঠ কলোনিতে থেকে কাজ করেছেন। তাঁরা কোথাও বসিয়েছেন নতুন গেট, কোথাও বালি-সিমেন্ট মাখিয়ে নিজেরাই সংস্কার করছেন ভগ্ন দেওয়াল। সেই সঙ্গে ‘কুষ্ঠ যে ছোঁয়াচে রোগ নয়’সে কথাও ছাত্রছাত্রীরা প্রচার করছেন। যে কাজ করা উচিত স্থানীয় প্রশাসন তথা স্বাস্থ্য দফতরের। এই কাজগুলোই প্রশাসনিক স্তরে ঠিকমতো হয় না বলে ক্ষোভ ওই কলোনির বাসিন্দাদের। তাঁদের অভিযোগ, শিক্ষাখাতে কিছু সাহায্য বা পশুপালনের জন্য সামান্য সাহায্য ছাড়া সরকারি তরফে তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। |
ঘটনা হল, প্রায় ১৩ দিন ওই কলোনিতে জাপানের পড়ুয়ারা থেকে গেলেও প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতর তা জানতই না! সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক (বিষ্ণুপুর) সুভাষচন্দ্র সাহা বলেন, “এলাকার কুষ্ঠ কলোনিগুলিতে ওষুধ, নানা খাতে সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়। যমুনাবাঁধ কুষ্ঠ কলোনিতে বাইরের কারা কী করছেন আমি জানি না।” বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক সুশান্ত চক্রবর্তীও জানতেন না। বলেছেন, “স্বাস্থ্য দফতরের কাছে খোঁজ নিতে হবে।”
সম্প্রতি ওই কলোনিতে গিয়ে দেখা গেল, কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন, আবার কেউ বালি-সিমেন্ট মেশাচ্ছেন। ক্লান্তি এলে কলোনির আবাসিকদের কাছ থেকেই জল চেয়ে খাচ্ছেন জাপানের ওই ছাত্রছাত্রীরা। ওই কলোনির বাসিন্দা তথা সারা বাংলা কুষ্ঠ কল্যাণ সমিতির বিষ্ণুপুর শাখার সম্পাদক যোগেন দাসের কথায়, “সরকারি সাহায্য আমরা সে ভাবে পাই না। জাপানের সাসাকাওয়া ফাউন্ডেশন কুষ্ঠ নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা কাজ করেছে বলে খবর পেয়ে মাস কয়েক আগে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম। ওরাই সাসাকাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন পড়ুয়াকে পাঠিয়েছে। তাঁরা ভেঙে পড়া ঘরবাড়ি মেরামত ও কলোনি পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করছেন। আমরাও হাত লাগিয়েছি।”
ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে ‘টিম লিডার’ এরিকো কাজিতা বলেন, “কুষ্ঠকে অকারণে ভয় করেন অনেকে। রোগটি মোটেই ছোঁয়াচে নয়। অথচ এঁদের সঙ্গে সমাজের একটা বড় অংশ দূরে থাকেন। সেই ব্যবধান ঘোচানোই আমাদের লক্ষ্য।” একই বক্তব্য এরিকোর সঙ্গী ইয়ো ইয়ো, আকি বা কান্তারাদের। ওই কলোনির বাসিন্দা কার্তিক কালিন্দী বলেন, “মঙ্গলবারই কাজ শেষ হয়েছে। সেই জন্য রাতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে ওই ছাত্রছাত্রীরাও যোগ দেন।” বাসিন্দা জিতেন কালিন্দী বলেন, “আমার বাড়ির নতুন গেট বসিয়ে দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা। আমরা খুশি।”
বুধবার কলোনি ছেড়ে নিজেদের দেশে রওনা হয়েছেন ওই ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু এই ক’দিনেই কুষ্ঠ কলোনির আবাসিকদের মন ভরিয়েছেন স্নেহে ও ভালবাসায়। সমাজের কাছে যা তাঁদের আশা, সেটাই ভিন দেশের কিছু পড়ুয়ার কাছে পেয়ে তাঁরা আপ্লুত। তাই তো কামেশ্বর সিংহ বা সুধীর কালিন্দীরা বলছেন, “ওঁরা যে ভাবে নিজের মতো করে কিছু কাজ করলেন, তার তুলনা হয় না।” |