পুস্তক পরিচয় ১...
পুরনো পুথির মতো সম্ভ্রম জাগায়
অলৌকিক সংলাপ, শিশিরকুমার দাশ। কারিগর, ২০০.০০
অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ, শিশিরকুমার দাশ। কারিগর, ৮০.০০
বিশিষ্ট পণ্ডিত, গবেষক, প্রাবন্ধিক, ভাষাবিজ্ঞানী ও অনুবাদক রূপে শিশিরকুমার দাশের দেশ-বিদেশ জোড়া খ্যাতি তাঁর কবি ও নাট্যকার পরিচিতিকে অনেকটাই ম্লান করে রেখেছিল। দুই দশকের অসম বন্ধুত্বের সুবাদে এমন আভাসও পেয়েছি যে এ নিয়ে ওঁর মনে বেশ খানিকটা ক্ষোভ ও অভিমান জমা হয়েছিল। চিন্ময় গুহ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উনি স্পষ্টই বলেছিলেন, “কলকাতায় চাকরি জুটল না।... এটাও বুঝলাম যাকে আপনারা সৃজনশীল সাহিত্য বলেন, সে-জগতের প্রবেশদ্বারগুলিও মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। আমি লেখা পাঠালে কেউ যে ছাপতেন না তা নয়, ছাপতেন, কিন্তু উত্তাপ ছিল না তাঁদের ব্যবহারে, আন্তরিকতা দূরের কথা। একটা উপেক্ষা, একটা উদাসীনতা আমাকে পীড়িত করত।” এই প্রেক্ষাপটে শিশিরকুমারের মৃত্যুর আট বছর পর নবকলেবরে ওঁর একটি কবিতার বই ও একটি নাটকের সংগ্রহ হাতে পেয়ে মনটা ভাল হয়ে গেল। বিশেষ করে এই জন্যে যে, বই দু’টি অত্যন্ত যত্ন সহকারে চমৎকার প্রচ্ছদে উন্নত মানের মুদ্রণ-পরিপাট্যে প্রকাশ করা হয়েছে।
শিশিরকুমার দাশের গ্রিক ভাষা শিক্ষার সূচনা ১৯৬৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, দু’বছর ভাষাতত্ত্ব চর্চা করার সময়ে। কর্নেলে গ্রিক ক্লাসে প্লেটোর ‘সক্রেটিসের জবানবন্দি’ ও এউরিপিদেসের ‘বাক্খাস্’-এর ইংরেজি অনুবাদ করতে হয়েছিল। দেশে ফিরে নিজে নিজেই গ্রিকচর্চা চালু রেখেছিলেন। তারই ফলে আমরা পেয়েছি বাংলায় সোফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ ও ‘রাজা ওইদিপৌস’, এউরিপিদিসের ‘বন্দিনী’, জর্জ সেফেরিসের ‘নির্বাচিত কবিতা’, গ্রিক কবিতার সংকলন ‘বহু যুগের ওপার হতে’ এবং ভূমিকা ও টীকা সহ আরিস্ততলের ‘কাব্যতত্ত্ব’-র অমূল্য বাংলা অনুবাদ। দেখেছি কী প্রচণ্ড নিষ্ঠা ও পরিশ্রম সহ পাগলের মতো কাজ করতেন তিনি! সম্ভবত এই ‘প্যাশন’-ই তাঁকে অনেক বৃহৎ কর্মকাণ্ড রেকর্ড সময়সীমার মধ্যে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছে। যা-ই হোক, গ্রিক নাটকগুলি যে শিশিরকুমারকে প্রচণ্ড ভাবে নাড়া দিয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়। ওই নাটকগুলি পড়তে পড়তে গ্রিক নাটক সম্বন্ধে, আর নাটকের থেকে উৎসারিত জীবনবোধ সম্বন্ধে ভেবেছেন তিনি। লক্ষ করেছেন, ভারতীয় জীবনবোধের সঙ্গে তার মিল ও অমিল। একবার একটা সেমিনারে আমন্ত্রণ এল ভারতীয় সাহিত্যে ট্র্যাজেডি বিষয়ে কিছু বলার। কথোপকথনের আকারে উনি লিখে ফেললেন নিজের বক্তব্য। স্বর্গে ট্র্যাজেডির উৎসব। আরিস্ততল এই নাট্যোৎসবের বিচারক। বিশ্বের সব বড় বড় নাট্যকার সেখানে সমবেত। গ্যেটে জোর করে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’-কে ঢুকিয়ে দিয়েছেন উৎসবে। শকুন্তলার অভিনয় দেখে বিভ্রান্ত আরিস্ততল ডেকে পাঠিয়েছেন কালিদাসকে। এই হল অলৌকিক সংলাপ বইটির শুরু। তারপর লেখা হল আরও ন’টি সংলাপ ছোট ছোট নাটক। ওঁর নিজের কথায়, “গ্রিক ও ভারতীয় নামক চিন্তাভাবনার তুলনামূলক আলোচনা এর লক্ষ্য নয়, তার যোগ্যতাও আমার নেই, কিন্তু একটি গ্রিক ও একটি ভারতীয় চরিত্রকে মুখোমুখি এনে আমি চেষ্টা করেছি একটা নাটক তৈরি করতে, যার মধ্যে আছে দুটো ভিন্ন পুরাণ, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, ভিন্ন ধরনের আততি।”
আরিস্ততল ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’-এ নাটক খুঁজে পান না, কারণ কোথাও কোনও নাট্য-সংঘাত নেই। আর কালিদাস বোঝাতে চান, ‘আমার নাটকের কেন্দ্রে আছে দুই বিরোধী শক্তির সমন্বয়, সংঘাত নয়।’ ‘তিন অন্ধ’ সংলাপে কুশীলব ধৃতরাষ্ট্র, ওইদিপৌস ও তেইরেসিয়াস। প্রথম দু’জনেই মর্ত্যজীবনে রাজা ছিলেন। এক জন জন্মান্ধ, অন্য জন স্বেচ্ছা-অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছেন নিজের চরম পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে। তৃতীয় জন ত্রিকালজ্ঞ মহাজ্ঞানী, যিনি নারীদেহের প্রতি অসংগত কৌতূহলে স্বর্গের সম্রাজ্ঞী হেরা-র রোষে প্রথমে এক নারীতে রূপান্তরিত হন ও পরে পুনরায় পুরুষদেহ ফিরে পান, কিন্তু অন্ধত্বের অভিশাপ-সহ। এঁদের ত্রিকোণ সংলাপ দেশ-কাল, সভ্যতা-বর্বরতা, দেবলোক-মর্ত্যলোক সংক্রান্ত জটিল সব প্রশ্ন তুলে ধরে। ঠিক তেমনই ‘দুই মাতৃঘাতী’-তে পরশুরাম ও ওরেসতেস, ‘মৃত্যুলোকে সশরীরে’-তে সাবিত্রী, বেহুলা ও এউরিদিকে এই তিন নারী, ‘দুই অতিথি’-তে দেবরাজ ইন্দ্র ও ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস কাহিনির পর কাহিনিতে দুই প্রাচীন সভ্যতার পুরাণ-গাথাগুলি যেন নতুন রূপে জীবন্ত উঠে আসে। সংলাপ শেষ হয়ে গেলে কানে বাজতে থাকে এমন সব অসাধারণ উচ্চারণ: ‘দেবতাদের বিশ্বাস করতে ভয় হয়। তাঁরা যে বড় কৌশলী। তাঁদের উপহারের মধ্যে থাকে উপহাস, করুণার মধ্যে থাকে অবহেলা, উদ্ধারের মধ্যে উপেক্ষা।’
প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন থেকেই শিশিরকুমার দাশের কবিতাচর্চার শুরু। ওই সময়ই ‘দেশ’, ‘পূর্বাশা’-র মতো নামী-দামি পত্রিকায় ওঁর অনেক কবিতা ছাপা হয়েছে। এম এ পাঠরত অবস্থায় বন্ধুবান্ধবের উৎসাহে ওঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ জন্মলগ্ন (১৯৫৬) প্রকাশিত হয়, স্বয়ং প্রমথনাথ বিশী যার একটি ছোট্ট সমালোচনা লিখেছিলেন। ত্রিশ বছর পরে, ১৯৮৬-তে প্রকাশ পায় বর্তমান সংকলন অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ হয়তো দরোজা আছে অন্য দিকে। ১৯৯২-এ কবি অমিতাভ গুপ্তের চেষ্টায় ও আগ্রহে শেষ কাব্যগ্রন্থ বাজপাখীর সঙ্গে কিছুক্ষণ। মাঝখানের এই দীর্ঘ নীরবতার একটা বড় কারণ অবশ্যই প্রবাসজীবনের বাস্তবিকতা। অধ্যাপনা ও গবেষণাকর্মের প্রায় সমস্ত অংশই তাঁর কেটেছে কর্নেল, লন্ডন ও দিল্লিতে। ফলে তাঁর কবিতাচর্চা ‘পরিবেশগত প্রার্থিত শুশ্রূষা’ পেয়ে ওঠেনি। ওঁর নিজের জবানিতে শোনা যাক, ‘কলকাতা থেকে দূরে থাকার যে ক্ষতি তা হল বাংলা ভাষা সাহিত্যের সজীব জগৎ থেকে দূরে থাকার ক্ষতি। যে ভাষায় একজন লেখে (আর আমার ভাষা বাংলা, ইংরেজিতে লেখা আমার স্বাধীন choice নয়, একটা compulsion), সে ভাষার চলমান, উদ্ভিন্নমান, পরিবর্তমান পরিবেশের মধ্যে তার থাকা আবশ্যিক এবং কাম্য। দূরে থাকা মানে এই পরিবর্তনের, রূপ বদলের ইতিহাসের স্রোত থেকে দূরে থাকা’। (চিন্ময় গুহকে দেওয়া পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকার)। হয়তো স্মৃতির শহর কলকাতাকে হারানোর অভিমানও ওঁর কাব্যচর্চাকে ব্যাহত করেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্যের কথা, যে ইংরেজিকে নিতান্তই ‘কমপালশন’ বলছেন শিশিরকুমার, সেই ইংরেজিতেই বই লিখে দু’বার রবীন্দ্র পুরস্কার অর্জনের বিরল কৃতিত্ব লাভ করেছেন তিনি (দ্য শ্যাডো অব ক্রস ১৯৭৪ এবং দ্য আর্টিস্ট ইন চেনস ১৯৮৬)। এবং এই ইংরেজিতেই তিন খণ্ডে আ হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার-এর মতো নতুন দিক্দিশারী ইতিহাস নির্মাণ করেছেন, আর করেছেন তিন হাজারেরও বেশি পাতার ইংলিশ রাইটিংস অব টেগোর-এর সংকলন ও সম্পাদনা।
কিন্তু এহ বাহ্য। অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ কাব্যগ্রন্থটির অন্তর্গত ১০২টি রচনার সব ক’টি তিন পংক্তির। পদান্তে মিল দেওয়ার কোনও চেষ্টা নেই, কোনও লেখার কোনও শিরোনাম নেই। সুধীর চক্রবর্তী মশাই যথার্থ বলেছেন, ‘সচেতন ভাবে কবি তার চতুর্থ চরণটি উহ্য রেখে তাকে অবলুপ্ত বলে চিহ্নিত করেছে।’ এবং ‘মনে হয় যেন এই কবিতার নিজস্ব ঘরানায় চতুর্থ চরণটি নিতান্ত উদ্বৃত্তের মতো তার কোনও নান্দনিক পরিসর নেই। কবিতার তিনটি মাত্র অপ্রগল্ভ চরণ এত বাঙ্ময় আর নিবিড় যে মন মেতে ওঠে।’ শিশিরকুমার দাশের এম এ ক্লাসের সহপাঠী ও আজীবন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুধীর চক্রবর্তী কাব্যগ্রন্থটির একটি অনবদ্য ‘কথামুখ’ লিখেছেন। স্মৃতিচারণে প্রত্যাশিত আবেগে উষ্ণ, বিশ্লেষণে অসামান্য মননে সমৃদ্ধ লেখাটি বইখানির বাড়তি সম্পদ।
এই বিচিত্র কাব্যগ্রন্থটির প্রথম পদটিই আমাদের কাছে এক অপার রহস্যময়তার ইঙ্গিত বয়ে আনে:

প্রথম চরণে তোলো বিদ্যুতের সুর
দ্বিতীয় চরণে তোলো মৃদঙ্গ মেঘের
এবার নর্তক রাখো তৃতীয় চরণ।


এ যেন কোনও এক মহাজাগতিক নৃত্যের সূচনা, যার ফলে দ্বিতীয় পদে ‘মেঘে মেঘে রক্ত ঝরে’ ও তৃতীয় পদে পাওয়া যায় ‘সমুদ্রের উদ্দাম সৌরভ’, সঙ্গে ‘হলুদ বালুর বুকে’ গানের আহ্বান। আবার পুরনো দিল্লির সৌধ ইমারত দেখতে দেখতে কবি যখন লেখেন:

যখন গোধূলি নামে জামা মসজিদে
মনে হয় ঈশ্বরের আরাধনা করি
ঈশ্বর কি মসজিদে, গোধূলিতে নয়?


অথবা

সম্রাটের কবরের ধারে ঝিঁঝিঁ ডাকে
দিল্লীশ্বর যদি আসে, চেনা কেউ থাক
পুরাতন কেউ নেই, ঝিল্লীস্বর ছাড়া।
’,

তখন শিশিরকুমারের কবিতাভাবনা অনায়াসেই সুফি সন্ত্ কবিদের কবিতাভাবনায় মিলেমিশে যায়।
এমন আশ্চর্য প্রেমের কবিতা কে কখন পড়েছে?

তোমাকে দিলাম নারী, আমার সন্ন্যাস
কঠিনতা, পরাজয়, অজিন, বল্কল,
তুমি দাও বিজয়ীর সপ্তপর্ণী পাতা।


এমন অদ্ভুত প্রেমপত্রই বা কে কখন লিখেছে?

এ চিঠিতে কথা নেই, শুধু নিস্তব্ধতা;
প্রশ্ন নেই, শুধু ঘন আকুল নিঃশ্বাস।
চুম্বনে খামের মুখ বন্ধ করেছিলে?


যে পৃথিবীতে বাস করছেন কবি, তাতে নিজের চার পাশে যে শয়তানি, নিষ্ঠুরতা, অশ্লীলতা ও মূর্খামো প্রতিনিয়ত নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে, তারই প্রতিক্রিয়া আমরা পেয়ে যাই দৃঢ়বদ্ধ তিন পংক্তির এমন পদগুলিতে:

বেদী থেকে টেনে এনে তোমাকে ধর্ষণ
করে দস্যু, সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয় লাস,
আমি মৌন, সমুদ্র গর্জন করে ওঠে।


অথবা

সন্ধ্যাবেলা সভা ডাকে কশাই-র দল
যাতে পক্ষপাতশূন্য হয় এ বিচার
একটি গরুকে তারা করে সভাপতি।


এই কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব ক’টি পদ-ই উদ্ধৃতিযোগ্য। আঙ্গিকগত দিক দিয়ে বইটির আরেকটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে শেষ করব। পুরো কাব্যগ্রন্থটিই শিশিরকুমার দাশের নিজস্ব হস্তলিপিতে টান-টান করে লেখা এবং তার থেকে ফ্যাকসিমিলি করে ছাপা। ফলে বইটি অনেকটা পুরনো পুথির মতো মনে সম্ভ্রম জাগায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় বন্ধুবর সুধীর চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ন’জন তরুণ কবির প্রেমের কবিতার যে সংকলন অমৃত-যন্ত্রণা নামে বেরিয়েছিল, সেটাও তাঁরই নিখুঁত হস্তাক্ষরে সজ্জিত ছিল। কবি-পরিচিতিতে সকলের কথা ফলাও করে অলংকৃত ভাষায় লিখে সবশেষে নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন তিনি “শিশিরকুমার দাশ। যশঃপ্রার্থী মন্দ কবি হয়েও, সুদূরস্থিত কাব্যশশাঙ্কর প্রতি বামনের মতো উদ্বাহু হয়ে উপহসিত হতে অনিচ্ছুক। তাই সাধনার ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থতা জেনেও সত্যনিষ্ঠ। সম্ভবত এই তাঁর কাব্যের পরম পরিচয়।” নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে জানতেন শিশিরকুমার দাশ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.