আজ ‘জাগরণ’।
সারা রাত ভাদু বন্দনা হবে রাঢ় বাংলার গ্রামে-গ্রামে। রাত পোহালে বিসর্জন। পরব ঘিরে মেতেছে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া, বস্তুত তামাম মানভূম। গানে-গানে ঘুরছে ভাদুর প্রতি ভালাবাসা, আর শ্রদ্ধা।
বস্তুত, ভাদুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবেই জড়িয়ে আছে গান। আর জড়িয়ে আছে পঞ্চকোট রাজবংশের নাম। সেই রাজবংশের উত্তরপুরুষ সোমেশ্বরলাল সিংহদেও শুনিয়ে চলেন ইতিবৃত্ত:
“তখন রাজা বিশ্বম্ভরশেখর সিংহদেওয়ের রাজধানী গড়পঞ্চকোটে। এক বার তিনি যুদ্ধে গিয়েছেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজ্যপাট সামলাচ্ছিলেন রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরী। সকলের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তিনি। হঠাৎ খবর আসে রাজা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন। আর তা শোনা মাত্র বাবার কাছে যাওয়ার জন্য যোদ্ধার বেশে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়েন ভদ্রেশ্বরী। পথে খবর পান শত্রুপক্ষ তাঁর বাবাকে বন্দি করেছে। এর পরে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ হবে, হবে অশেষ লাঞ্ছনা এই আশঙ্কায় আর শোকে রাস্তার পাশে এক পুকুরে ঘোড়া-সহ প্রাণ বিসর্জন দেন তিনি।”
পঞ্চকোট রাজবাড়ির মেয়েরা প্রজাদের মধ্যে ‘বাবি’ নামে পরিচিত ছিলেন। পঞ্চকোট পাহাড়ের কাছে ‘বাবিরবাঁধ’ নাম সেই পুকুর আজও আছে। সোমেশ্বরবাবু বলে চলেন, “রাজার বন্দি হওয়ার খবর ভুল ছিল। তিনি পরাজিতও হননি। প্রাসাদে ফিরে কন্যার আত্মবিসর্জনের খবর পেয়ে তিনি ভেঙে পড়েন। শোক ভোলাতে ভদ্রেশ্বরীর প্রতিকৃতি গড়ে তাঁর সামনে রেখে রাজকন্যার গুণকীর্তন করতে থাকেন পাত্র-মিত্র-অনুচরেরা। পরে ভদ্রেশ্বরীর স্মৃতিতে বহু গানও রচনা করেছিলেন সঙ্গীতজ্ঞেরা। সেই সব গান মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।” |
ভদ্রেশ্বরী থেকেই আদরের ভাদু। তাঁর আত্মবিসর্জনের দিন ৩০ ভাদ্র। প্রতি বছরই ভাদ্র শেষের সন্ধ্যায় তাই সুরে সুরে ছড়িয়ে যায় ‘শারদ সন্ধ্যায় রমণীয়/ বন্দি তোমারে প্রিয় হে...’ বা আরও বহু গান। এক সময়ে অবশ্য কাশীপুরে রাজবাড়ির অলিন্দে গোটা ভাদ্র মাস জুড়েই ভেসে বেড়াত পঞ্চকোট ঘরানার রাগাশ্রয়ী ভাদুগান। ইমন, বেহাগ, দেশ, খাম্বাজ, দরবারি, বিলাসখানি টোড়ির মেজাজি মৌতাত জড়িয়ে যেত খিলানে, ঝাড়বাতিতে। সোমেশ্বরবাবুর খেদ, “সেই জৌলুস আর নেই। ভাদু অনেকটাই আমাদের অন্দরমহলের মধ্যে আটকে গিয়েছে।”
তবে এ-ও পুরো সত্যি নয়। রাজবাড়ির খানদানি চলন ছাপিয়ে ভাদু ঢুকেও পড়েছে মানভূমের ঘরে ঘরে। কিন্তু সে ধ্রুপদী ভাদু নয়, লোকায়ত। পুরুলিয়ার লোকগবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “আদরের কন্যাই বলুন বা দেবী ভাদুর ইতিবৃত্ত ছুঁয়েছে মানুষের আবেগ। সেই জনপ্রিয়তার জোরেই রাজবাড়ির ভাদু ‘লোকায়ত ভাদু পরব’ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তা মানুষের এতটাই আপন হয়ে গিয়েছে যে এখন ভাদুগানে রোজকার সুখ-দুঃখের কথাও থাকে।”
তবে, পঞ্চকোট রাজবাড়ি ভুলতে পারে না চলে যাওয়া সেই সময়ের কথা। যেমন ভুলতে পারেন না সঞ্জয় সূত্রধর, সুশীল সাহা, সজল গোস্বামীর মতো স্থানীয় সঙ্গীতরসিকেরা। তাঁদের মনে পড়ে, “সারা ভাদ্র মাস জুড়ে রাজবাড়িতে আসর বসত। নানা রাগে কী সব ভাদু গান! সে অবিস্মরণীয়!”
তবে শুধু স্মৃতি আঁকড়ে বসে না থেকে নতুন উৎসাহে ধ্রপদী ভাদু চর্চাও ফের শুরু হয়েছে। সঞ্জয় নিজে গান করেন। যেমন করেন শিল্পী নিত্যানন্দ দে-ও। তাঁদের কথায়, “পঞ্চকোট ঘরানার ভাদুগানে সঙ্গীতের যে সম্পদ রয়েছে, নতুন প্রজন্মকে তা জানাতেই গোটা ভাদ্র মাস জুড়ে ভাদুগানের আসর বসানো হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে আমরা এই কাজ করে যাচ্ছি।”
সুখের কথা। আশারও।
আজ, শনিবার ভাদু জাগরণের রাতে ফের সেই ইমন-বেহাগ-দরবারি ছড়িয়ে পড়বে পঞ্চকোটে।
আশ্বিনের প্রথম ভোর জানবে, দ্রুত পাল্টাতে থাকা সময় আজও গ্রাস করতে পারেনি মায়াবী সেই ভাদুকে। |