অভাবের সংসারেই আসেন অন্নদা
তাঁত ঘরের ছাউনির টিন, সুতো শুকোনোর বাঁশ। এই দিয়ে তৈরি আনাড়ি হাতের মণ্ডপ কি আর ঝোড়ো হাওয়ার সামনে টেঁকে? কিন্তু তাতে পুজো আটকায়নি।
মঙ্গলকাব্য জুড়ে রয়েছে অভাব দারিদ্রের গল্প। বাংলার সেই অন্তরের গল্পে দারিদ্রের হাত থেকে বাঁচানো যায়নি ঠাকুর দেবতাদেরও। তাঁদেরও সংসারের হাল সেই নুন আনতে পান্তা ফোরায়। কিন্তু সেই দুর্গা, অন্নদা, অভয়ার সংসারে অভাব ছায়া ফেলতে পারেনি ইতিকতর্ব্যে। দুর্গা, চণ্ডীও কখনও দুর্যোগ-অভাবের জন্য পুজো থেকে বঞ্চিত হননি, সব সমস্যার মধ্যেই উমা যেমন বাংলার গ্রামের বধূর মতোই ভোলানাথের সংসার টেনে নিয়ে যান নিজের মতো করে। সেই গল্পের কথা কিন্তু গল্পেই থেমে থাকে না।
ভগীরথপাড়ায় মহিলাদের পুজোতে সেই সংসারেরই যেন ছায়াও পড়ে। বৃষ্টির দাপটে যখন চারপাশ ভিজে একশা, আয়োজন সব ভেসে যেতে বসেছে, তখন প্রাণে ধরে বুকে চেপে সে সব বাঁচিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আঁচল দিয়ে মুছে দিয়েছেন অভাব। জল কাদায় থইথই চারপাশ। কিন্তু গাছের নারকেল আর ঘরের বাতাসা তো রয়েছে। অন্নদার পুজো হয়েছিল তাই দিয়েই।
শুধু তাই নয়, দিন আনা দিন খাওয়া তাঁত শ্রমিকের ঘরের মেয়ে বৌরা সম্মানের সঙ্গে সে বার অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে পেরেছিলেন আর পাঁচ জনের মতো করেই। দশমীর সকালে মায়ের কপালে সিঁদুর দিতে মেতে উঠেছিলেন সিঁদুর খেলায়।
এ কথা ২০০৯ সালের। নবদ্বীপের পানশীলা পঞ্চায়েতের ভগীরথ পাড়ায় তার আগে কোনও দুর্গাপুজো হত না। হওয়ার কথাও নয়। গোটা পাড়াই যে শতাধিক নিম্নবিত্ত তাঁতশ্রমিকদের। তাঁদের পক্ষে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা সম্ভব ছিল না। তাই পুজোর ক’টা দিন এই পাড়া আর ক’টা দিনের চেয়েও সাধারণ। বরং একটা যন্ত্রণাই ছিল। নিজেদের পাড়ায় পুজো নেই। অন্য পাড়ায় গেলে সম্মান নেই। আর নেই দারিদ্র থেকে মুক্তির উপায়।
কিন্তু মলিনা সাহা, বীণা মণ্ডল, রেবা সমাদ্দার বা স্বপ্না দাসেরা গত তিন চার বছর ধরে সেই ছবিটাই বদলে দিয়েছেন। তার আগে পুজোর দিনগুলো সহ্য করতে পারতেন না। এমনকী, ছেলেমেয়েগুলো যে নতুন পোশাক পাবে, তা-ও সুনিশ্চিত করতে পারতেন না যে প্রতি বছর। অন্য পাড়ায় অঞ্জলি দিতে গেলে বসে থাকতে হত দূরে। দশমীর দিন জগন্মাতাকে সিঁদুর দেওয়ার অধিকার ছিল না। অনেক দূর থেকেই পুজো দেখতেন তাঁরা।
সেই পুজোকে ঘরের উঠোনে আনতে কোমর বেঁধে পাড়ার মেয়ে বৌরা নামার পরে আঁতকে উঠেছিলেন পুরুষেরা। কিন্তু জেদের কাছে হারও মেনেছিলেন। ২০০৬ সালে নমো নমো করে একটা পুজোও হয়েছিল। তার পরের বছর কিন্তু প্রতিমা এনেও তাঁকে ঠাঁই দিতে পারেনি অভাবী ঘরনীরা। বন্যায় সে বছর ভেসে গিয়েছিল পথ-ঘাট। লজ্জায়-অপমানে ভগীরথপাড়া অন্য পুজোর আয়োজনে যোগ দিতে যেতে পারেননি।
পরের বছরও কেটেছিল সেই ভাবেই। কিন্তু তার পরের বছর থেকে পুজোয় ছেদ পড়েনি। বীণাদেবী বলেন, “আমাদের আয়োজন খুব সামান্য। ১০-১২ হাজার টাকার মধ্যে সব মেটাতে হয়। নিজেরা সারা বছর এক টাকা দু’টাকা করে জমাই, তাই দিয়েই পুজো তুলতে হয়।” রেবাদেবীর কথায়, “প্যান্ডেল বলতে একটা ত্রিপলকে বাঁশের উপর দিয়ে দু’ভাঁজ করে নামিয়ে দেওয়া। খুব ছোট একটা প্রতিমা। আর আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নৈবেদ্য।” কিন্তু তাঁর কথায়, “সান্ত্বনা কেবল একটাইএ আমাদেরই পুজো। এখানে কেউ আমাদের মুখ ঝামটা দেবে না। অঞ্জলি দিতে বা সিঁদুর দিতে গেলে করুণার পাত্রী হতে হবে না।”
স্বপ্নাদেবী বলেন, “আগে তবু পুজোর মুখে বাচ্চাদের একটা জামা-কাপড় কিনে দিতে পারতাম। এখন তিন বছর ধরে তা-ও দিতে পারি না পুজোর খরচের জন্য।” দরিদ্রের সংসারে পুজো কিন্তু তবু আসে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.