‘মৃত্যু’র আগে শেষ প্রোমো! যা ঘটল ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১। ‘মৃত্যু’-- মানে ক্রিকেট থেকে পূর্ণাঙ্গ অবসর কবে? মনে হচ্ছে ২৮ জানুয়ারি ২০১২-র অ্যাডিলেড ওভাল। সে দিনই যে ভারতের অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সফর সমাপ্ত হওয়ার কথা। ব্র্যাডম্যানের শহরেই চলে যাওয়ার চেয়ে প্রকৃষ্ট মঞ্চ আর কী হতে পারে?
শুক্রবার অবশ্য রাহুল শারদ দ্রাবিড়ের ক্রিকেটজীবন কবে প্যাকিং বাক্সে ঢুকে পড়বে তা আলোচনার দিন নয়। তার জন্য সময় পড়ে রয়েছে। পরিস্থিতি পড়ে রয়েছে। শুক্রবারের কার্ডিফ এই মহাবিপর্যয়ের সফরেও ভারতের জন্য খুশির মিনি-দীপাবলি হিসেবে হাজির ছিল। সেই দীপাবলির রংমশাল, তুবড়ি, চরকি, ফুলঝুরি সবই দ্রাবিড়!
চিরকাল এটাই হয়ে এসেছে যে, দ্রাবিড় যতই খেলুন তাঁর রানটা ঢেকে যাবে কোথাও না কোথাও অন্য কারও চমকপ্রদ আবির্ভাবে। সে বোলার হতে পারে। ব্যাটসম্যান হতে পারে। কিন্তু অনিবার্য ভাবে হাজির হবেই। অথবা সচিনের মতো বৃহত্তর তারকা এসে নতুন কোনও কীর্তিতে পুরো আলো নিয়ে চলে যাবে। বা বিপক্ষ দলে উৎপটাং কেউ এমন কিছু করে ফেলবে যে পারফরম্যান্সের রোশনাইয়ের মূল্যই পাবেন না রাহুল। এ বারের ইংল্যান্ড সফর থেকেই বিচার পদ্ধতিটা বদলে গিয়েছে।
ওয়ান ডে-তে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক, বেশি ম্যাচ জেতানো, এ দিন কমেন্ট্রি বক্সে বসে থাকা তাঁর বন্ধু কবে জীবনের শেষ ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেছিলেন বেহালাতেও লোকে চট করে বলতে পারবে না। একদিনের ক্রিকেটে ভারতের সর্বকালের সেরা বোলার কুম্বলে কবে যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে শেষ ওয়ান ডে খেলে ফিরেছেন কেউ খেয়ালও করেনি। |
অথচ তিনি----দ্রাবিড় শেষ ম্যাচে নিজেকে নিয়ে অসাধারণ নাটক তৈরি করে দিয়ে গেলেন। বিরাট কোহলির সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে দেড়শোর ওপর রান যোগ করা। জীবনের শেষ ওয়ান ডে ম্যাচে ৭৯ বলে ৬৯। এগুলো তো শুকনো পরিসংখ্যান। দক্ষ কুইজার ছাড়া দু’দিন বাদে কেউ গড়গড় করে বলতে পারবে না। মনে থেকে যাবে মাাঠে দ্রাবিড়ীয় অবসর নিয়ে অসাধারণ এই রং তৈরি। এ বারের ইংল্যান্ড সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধার নতুন বেদি-ই তৈরি করে দিয়েছে তাঁর জন্য। এ দিন সেই বেদির ওপরে রোম্যান্টিকতার অনুপম ত্রিপল বিছিয়ে দিয়েছিল যেন কেউ। স্টিভ ওয়-র চলে যাওয়া আরও বর্ণাঢ্য, আরও রঙিন। কিন্তু ৩৯ বছরের বুড়োর জন্য যেন সেই স্টিভ উদ্ভুত প্রতিক্রিয়াই। যেখানে ব্যক্তি, দল বা পারফরম্যান্সের উর্ধ্বে উন্মাদনার একটা শৃঙ্গ তৈরি করে ফেলতে পেরেছে। জীবনের শেষ ওয়ান ডে ম্যাচে এত সম্মান কে কোথায় পেয়েছে? স্বয়ং স্টিভতিনিও পাননি।
কী না হল গ্ল্যামারগনের মাঠে রাহুলের জন্য! উচ্ছ্বসিত সমর্থকেরা চতুর্দিকে তাঁর জন্য প্ল্যাকার্ড তুলে ধরছে। নাচছে, হাততালি দিচ্ছে। যেন সিরিজ হারের শোক ভুলে গিয়েছে। বিপক্ষ ইংরেজ ক্রিকেটাররা দ্রাবিড় বোল্ড হওয়ার পর একে একে এসে হাত মিলিয়ে যাচ্ছে। বিরাট কোহলির সেঞ্চুরির জন্য বাইরে বেরিয়ে আসা ভারতীয় ড্রেসিংরুম তুমুল হাততালিতে তাঁর সিঁড়ি দিয়ে ফেরত আসাকে আভিজাত্য দিচ্ছে। গোটা মাঠ উঠে দাঁড়িয়ে। হাততালি থামছে না। তিনি---দ্রাবিড় চারদিকে ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে উঠে যাচ্ছেন, এটা তো সচিনোচিত বিদায়ী অভ্যর্থনা। দ্রাবিড়ের তো এ সব পাওয়ার কখনও আইন ছিল না। তিনি বরাবর টিমের নায়ক। অধিনায়কের নায়ক। জনতার বক্স অফিস নন। আর সেই জনতার হাততালিতে মিশেই কি না মিলিয়ে গেল তাঁর একদিনের ক্রিকেটের নশ্বর দেহ। কে বলেছে বিচার শুধু বাস্তবে হয়, আদালতে হয়!
দৃশ্যত দ্রাবিড় ‘আন্ডারস্টেটমেন্ট’-এর পতাকাবাহী বিশ্বস্ত সৈনিক। নিজের সম্পর্কে ‘খুব ভাল’কে যিনি বরাবর বলে এসেছেন ‘প্রয়োজনীয়’ বা ‘ওই দিনের জন্য ঠিক ছিল।’ বাইরে থেকে মনে হবে আপাদমস্তক গদ্যের লোক। কাঠকাঠ লোক। আবেগ কম। আর সেটা ভুল মনে হবে। আবরণ যা-ই হোক মানুষটা ভেতরে জলে ভেজা পদ্য। আর সেই পদ্যের কোটিং জীবনের শেষ একদিনের ম্যাচে হাজির হয়ে, তাঁকে হাফসেঞ্চুরি পাইয়ে দিয়ে যেন আরও মহাবরণীয় করে দিল শেষ ওয়ান ডে যাত্রা।
দ্রাবিড় বরাবর চেয়ে এসেছেন দল কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাচ্ছে তাঁর রানে এবং জিতছে। এ দিন আউট হয়ে যখন ফিরছেন তখন আন্দাজ করা যাচ্ছে ভারত তার অভিশপ্ততম সফরে যাতে জয়ের মুখ দেখে তার উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য করে এসেছেন। কিন্তু শুক্রবারের কাহিনি যে জেতা বা হারার নয়। তার চেয়ে অনেক দিগন্তবিস্ম্ৃত। সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার তা উৎসব মঞ্চ। কার্ডিফের ম্যাচ টিভিতে লাইভ দেখতে দেখতে বারবার কমার্শিয়াল অ্যাডের মতো টিভি স্ক্রিনের ওপর হাজির হচ্ছিল ১৯৯৬ জানুয়ারি। বেঙ্গালুরু। ভারতীয় বিশ্বকাপ দলের কন্ডিশনিং ক্যাম্প। আজহারের দল সে দিনই ঘোষণা হবে। খুব আশা করে রয়েছেন পঞ্জাবের ওপেনার বিক্রম রাঠৌর। রাতে দল ঘোষণার পর যন্ত্রণাবিদ্ধ রাঠৌরের প্রতিক্রিয়া নিতে গিয়েছি। হোটেলের ঘরে বসে বলছেন, “ভাবতে পারছি না আমাকে বাদ দিল। কী করে ভুলব এই যন্ত্রণা?” পরক্ষণেই যোগ করছেন, “আমার রুমমেটটা অদ্ভুত। দুঃখ-শোকে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। টিম শুনল। বলল, ও আমি নেই? কিটস নিয়ে বেরিয়ে গেল।”
এর বহু-বহু বছর বাদে এক রাতের আলোচনায় রাহুল দ্রাবিড় ব্যাখ্যা করবেন বেঙ্গালুরুর হোটেল থেকে কিটস নিয়ে সে দিন নীরবে বেরিয়ে যাওয়াকে। “কী করতাম আমি? বসে কাঁদতাম? আমি দ্রুত হিসেব করলাম ইংল্যান্ড ট্যুরের টিম সিলেকশনের আগে চারটে রঞ্জি ম্যাচ পাচ্ছি। নিজেকে বললাম, এখানে বাদ মানে ওই চারটে ম্যাচেই তোমার সেঞ্চুরি চাই। সেটা করেওছিলাম।”
সংক্ষেপে এই--দ্রাবিড়। এই তাঁর সাদামাঠা অথচ রোম্যান্টিক দর্শন। ফার্স্ট লিস্টে যদি বা না থাকো, গায়ে মেখো না। যদি অবিচার হয়ে থাকে অপমান মনে পুষে বসে থেকো না। এমন কিছু করো যাতে ক্লাস শুরু হওয়ার পর মনে হয় তুমিই অরিজিন্যাল ফার্স্ট বয়। আর কখনও ইগো দেখিও না। মেনে নাও নিজের সীমাবদ্ধতাকে। মেনে নাও তুমি সচিন নও। এ বার প্রতিজ্ঞায়, পরিশ্রমে চেষ্টা করো সচিনকেও পেরিয়ে যেতে। সেই যাত্রাটাই তোমার রোম্যান্স।
আজহার-পুত্রের মৃত্যুতে। টাইগার পটৌডির কঠিনতম অসুস্থতায়। দ্রাবিড়ের ওয়ান ডে ব্যাট তুলে রাখায়। ভারতীয় ক্রিকেটের এক কালো শুক্রবার। কিন্তু এই শুক্রবারই যে সোনালি জীবনধারারও জাতক।
তুমিও পারবে যদি তোমার অভীষ্ট বিষয় নিয়ে তপস্যায় ডুবে থাকতে পারো। অপমান হয়তো অনেক আসবে। কিন্তু তপস্যা যদি খাঁটি হয়, শেষ দৃশ্যে ওই লোকগুলোই তোমায় ডাকবে মেডেলটা তুলে দিতে। বিদায় দ্রাবিড়। স্বাগত দ্রাবিড়-সভ্যতা। |