পশ্চিমবঙ্গ নামক ‘মরূদ্যান’-এ বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনকালে বেআইনি মদের ভাটি রমরম করিয়া চলিয়াছে। সেইগুলি ভাঙিবার চেষ্টা করিলে মহিলারা সর্বত্র নিগৃহীত হইয়াছেন। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনেও সাঁতরাগাছিতে এক মহিলা ও তাঁহার কন্যার কপালে নির্যাতন এবং অবমাননা জুটিল। এই ঘটনা দেখাইয়া দিল, পুলিশ-গুণ্ডা-রাজনৈতিক নেতার দুর্নীতিচক্রের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সাধারণ মানুষ কত অসহায়। মহিলাদের উপর আক্রমণের অর্থ কেবল দৈহিক আঘাত নহে, সামাজিক মর্যাদায় আঘাত সেই আশঙ্কার কথা মেয়েরা ভালই জানেন। তৎসত্ত্বেও স্বপ্না দে ও তাঁহার প্রতিবেশী মহিলারা যখন স্বাক্ষর সংগ্রহ করিয়া, পুলিশের কাছে আবেদন-নিবেদন করিয়া এবং জনপ্রতিনিধির নিকট দরবার করিয়া বেআইনি মদের ভাটি তোলার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তখন স্পষ্ট হইয়া যায় চোলাই কারবারিদের দৌরাত্ম্যের ফলে তাঁহারা কতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতেছিলেন। ইহা লক্ষণীয় যে প্রতিবাদের প্রক্রিয়া স্থির করিতে তাঁহারা জনজীবন অচল করিয়া দিবার চেষ্টা করেন নাই। শান্তিপূর্ণ নাগরিক উপায়ে সমস্যা প্রতিকারের উদ্যোগ করিয়াছিলেন।
তাঁহাদের উপর চোলাই-কারবারিদের পরিকল্পিত আক্রমণ তাই আরও বেশি শঙ্কাজনক। কারণ তাহা কেবল ওই মহিলাদের বিপন্ন করে নাই, জনসমাজকেও বিপন্ন করিয়াছে। ইতিপূর্বে চোলাই মদ খাইয়া পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যু হইবার পর ২০০৯ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত চোলাই কারবারিদের জন্য ১০০ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প ঘোষণা করিয়াছিলেন। ক’জন চোলাই ব্যবসায়ী তাহার সুযোগ লইয়াছে, তাহা আজও জানা যায় নাই। কেবল স্বপ্নাদেবীর নিগ্রহের ঘটনায় ইহা স্পষ্ট যে, বেআইনি মদের ব্যবসা, এবং তৎসংলগ্ন সামাজিক অপরাধগুলি বন্ধ করিতে পুলিশ-প্রশাসন ব্যর্থ হইয়াছে। ফলে এ রাজ্যের সাধারণ মহিলাদের অবস্থা হইয়াছে দুর্বিষহ-- তাহারা ঘরে মাতাল স্বামীর হাতে নিগৃহীত হয়, বাহিরে লম্পট দুষ্কৃতীর দ্বারা আক্রান্ত হয়।
মদের ভাটি তুলিবার ব্যর্থতা এ রাজ্যে নারী আন্দোলনের শক্তিহীনতারও একটি লক্ষণ। আশির দশকে নারী আন্দোলন যখন এ রাজ্যে অত্যন্ত বলবান হইয়াছিল, তখন মধ্যবিত্ত হইতে দরিদ্র, সকল নারী একযোগে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিয়াছিল। ফলে কন্যাপণ, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধের বিরুদ্ধে আইন কঠোর হইয়াছিল, পুলিশ-প্রশাসনকেও আরও দায়বদ্ধ করা গিয়াছিল। সেই সময় মহিলাদের সমর্থন আদায় করিবার উদ্দেশে প্রায় সব রাজনৈতিক দল একটি মহিলা শাখা শুরু করিয়াছিল। দুঃখের বিষয়, মহিলাদের নানা সমস্যার রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সমাধানের জন্য মহিলা শাখার সদস্যরা দরিদ্র, বিপন্ন মহিলাদের পাশে দাঁড়ায় নাই। মহিলা সংগঠনগুলিও আন্দোলনের পথ ছাড়িয়া সরকারি অনুদানে সমাজ সংস্কারে লাগিয়া পড়িয়াছে। ফলে স্বপ্নাদেবীর নিগ্রহের মতো গুরুতর ব্যাপারেও তাহাদের কোনও হেলদোল দেখা যাইতেছে না। মহিলা কমিশনও বহু পূর্বেই সরকারি প্রশাসনের একটি দফতরে পরিণত হইয়াছে। তদন্ত করিবার, রিপোর্ট জমা দিবার এবং সভায় বক্তৃতা করিবার কাজেই তাহাদের ভূমিকা শেষ। অসুস্থ, যন্ত্রণাকাতর স্বপ্নাদেবী এবং তাঁহার প্রতিবেশীদের প্রচেষ্টাকে এক বৃহত্তর প্রতিবাদে পরিণত করিবার কাজটি করিবার কেহ নাই। সংবাদের আলো সরিলেই তাঁহারা পুনরায় ভয় এবং নির্যাতনের অন্ধকারে ফিরিয়া যাইবেন। |