স্কুলের পঠনপাঠনে ফাঁকি দিয়া ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশে যোগদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে চলিয়াছে রাজ্য সরকার। এই নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য। স্কুলের কাজ পড়ুয়াদের পঠনপাঠন। পড়াশুনার নাম করিয়া বাড়ি হইতে স্কুলে গিয়া ছাত্র ইউনিয়নের ‘দাদা’দের নির্দেশে বা হুমকিতে ক্লাসের বদলে রাজনৈতিক দলের মিছিলে ভিড় বাড়ানো পড়ুয়াদের কাজ নয়। ইহা হইতে নিবৃত্ত করিতে সরকার ভবিষ্যতে শাস্তি দিবার হুমকিও দিয়াছে। আশা করা যায়, অতঃপর রাজনৈতিক দলের মিছিল-সমাবেশে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা কচিকাঁচাদের ঘর্মাক্ত শরীর ও স্তম্ভিত মুখের ভিড় কলিকাতা ও রাজ্যের অন্যত্র দেখা যাইবে না। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং কলিকাতা হাইকোর্টের তৎপরতার ফলেই এ ব্যাপারে সরকার অপেক্ষাকৃত সহজে ব্যবস্থা লইতে পারিয়াছে। উপরন্তু জনমত এ ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সম্পূর্ণ পক্ষে থাকাও সুবিধাজনক হইয়াছে। তাহার অর্থ এই নয় যে, সকলেই এই সিদ্ধান্তে খুশি হইয়াছে। রাজনৈতিক দলগুলি বরাবর তাহাদের ছাত্র শাখাগুলিকে লালন করিয়া থাকে। ওই সব শাখা সংগঠন হইতেই ‘সম্ভাবনাময়’ ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের ছাত্রনেতা হিসাবে গড়িয়া তোলার জন্য শনাক্ত করা হয়। অতঃপর মিছিল-সমাবেশে যোগদান মারফত হাতে-কলমে তাহাদের ‘প্রশিক্ষণ’ চলে। স্বভাবতই রাজনৈতিক দলগুলি খুশি নয়। কোনও কোনও ছাত্র সংগঠন স্কুল-পড়ুয়াদের মিছিলে যোগদানের নিষেধাজ্ঞায় নিমরাজি থাকিলেও সক্রিয় রাজনীতির অঙ্গন হইতে পড়ুয়াদের নির্বাসিত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছে। এ ব্যাপারে বামপন্থী দলগুলিই অধিকতর উদ্বিগ্ন। ‘কিশোর বাহিনী’র মতো স্কুল-পড়ুয়াদের রাজনৈতিক সংগঠন তো বাম নেতা-কবির উদ্যোগেই গড়িয়া উঠিয়াছিল। স্কুলে হাজিরা না দিয়া রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ লইলে তাহা কী ভাবে ঠেকানো যাইবে বা আদৌ তাহা ঠেকানো উচিত কি না, এমত প্রশ্নও কেহ কেহ তুলিয়াছেন। এই ধরনের প্রশ্ন ও সংশয়ের অন্তরালে নাগরিক হিসাবে পড়ুয়াদের গণতান্ত্রিক অধিকার বিপন্ন করা হইতেছে কি না, তেমন সন্দেহও প্রচ্ছন্ন রাখা হইতেছে। এতৎসত্ত্বেও সরকারের সিদ্ধান্তকে অধিকাংশ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই স্বাগত জানাইয়াছেন, যাঁহাদের মধ্যে রাজ্যের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাও আছেন। স্বাগত জানাইয়াছেন অভিভাবকরাও, প্রায়শ রাজনৈতিক দাদাদের ভয়ে যাঁহারা ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত হইলেও মুখে কুলুপ আঁটিয়া থাকিতে অভ্যস্ত ছিলেন।
কেহ কেহ বলার চেষ্টা করিতেছেন, অভিভাবকদের অনুমতি লইয়া স্কুল-পড়ুয়ারা মিছিল-সমাবেশে গেলে তাহাতে আপত্তি তোলা হইবে কেন? আপত্তি এ জন্যই তোলা উচিত যে, নাগরিক হিসাবে স্কুল-পড়ুয়াদের অধিকার অভিভাবকদের অনুমোদনসাপেক্ষ নয়। অভিভাবকরাই, অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরাই, শিশুসন্তানকে শ্রমে নিয়োগ করিয়া থাকেন। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর সন্তানকে শিশুশ্রমিক বানাইবার অধিকার সংবিধান বাবা-মাকেও দেয় নাই। দেশে নারী পাচারের শিকার হইয়া থাকে যে হাজার-হাজার মেয়ে, অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা-ই তো অভাবের তাড়নায় অর্থের বিনিময়ে তাহাদের আড়কাঠি বা দালালের হাতে তুলিয়া দেন। শিশুকন্যার প্রতি সংঘটিত এই ঘোরতর অন্যায় আইনত শাস্তিযোগ্য একটি ফৌজদারি অপরাধ, যাহা শিশুর নিজস্ব মানবাধিকার দলন করে। সুতরাং অভিভাবক বা বাবা-মায়ের অনুমতি থাকিলেই কোনও কাজ আপনিই আইনসম্মত হইয়া যায় না। তাহা ওই শিশুসন্তানের মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন করে কি না, তাহাও এ ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের সহিত বিবেচ্য। অভিভাবকদের অনুমতি লইয়া কিংবা শিশুদের ভুল বুঝাইয়া বা লোভ দেখাইয়া রাজনৈতিক কর্মসূচিতে টানিয়া লইয়া যাওয়াও একই ধরনের অপরাধ। সরকারের সিদ্ধান্ত কঠোর ভাবে রূপায়ণ করা জরুরি। |