সহমতের ভিত্তিতে শহরকে রাজনৈতিক হোর্ডিং এবং মিছিল-সমাবেশের ফাঁস থেকে মুক্তি দিতে যে বৈঠক ডাকা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হল রাজনৈতিক চাপানউতোরের মঞ্চে।
বস্তুত, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বদলে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আর এক সদস্য মহম্মদ সেলিমকে পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা সর্বদল বৈঠক এ যাত্রায় ‘সফল’ হতে দিল না সিপিএম-ই!
সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা’ বলার অভিযোগ এনে দৃশ্যতই ‘ক্ষুব্ধ’ মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকের পর বলেছেন, পুজোর পরে ফের সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করবেন। রাজনৈতিক হোর্ডিং সরানো এবং সভা-সমাবেশের স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া নিয়ে সব দলের লিখিত মতামত চেয়েছে সরকার। পক্ষান্তরে, প্রধান বিরোধী দল সিপিএম প্রশ্ন তুলেছে, সরকারের তরফে কোনও লিখিত প্রস্তাব না-পেলে কীসের ভিত্তিতে মতামত দেওয়া হবে?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা এর আগে রাজ্যের নামবদল নিয়ে দু’টি সর্বদল বৈঠক ডেকেছিলেন এবং দুই ক্ষেত্রেই ‘সর্বসম্মতি’র ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গিয়েছিল। মহাকরণের রোটান্ডায় শুক্রবারের বৈঠকে ছিল সম্পূর্ণই অন্য ছবি। তবে এই বৈঠকের বিষয়বস্তুই নিয়ে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম এবং সরকারের শরিক কংগ্রেস-সহ একাধিক দলের আগেই আপত্তি ছিল।
আরও একধাপ এগিয়ে সিপিএম এ বার ‘পরিকল্পনামাফিক’ বৈঠকে পাঠিয়েছিল দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ সেলিমকে। সংসদীয় রাজনীতি থেকেই সেলিমের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ‘অহি-নকুল’। লোকসভায় দু’জনে থাকাকালীন যেমন তাঁদের মধ্যে তীব্র বিতন্ডা হয়েছে, তেমনই তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে হাজরার কাছে সরকারি হাসপাতালে সেলিমের চিকিৎসক স্ত্রী রোজিনা খাতুন ‘ঘর দখল’ করে আছেন বলে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা অভিযোগ তোলায়। |
সিপিএমের লক্ষ্য ছিল, ‘সুবক্তা’ সেলিম যুক্তি সহকারে ‘আক্রমণাত্মক’ ভঙ্গিতে হাল্কাচালে, খোঁচা দিয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করবেন। এবং তিনি বক্তা বলেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা সহজে ‘রুষ্ট’ হবেন। সেলিম নিজেও বিলক্ষণ তা জানতেন বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। ‘চিত্রনাট্য’ স্থির করেই বৈঠকে গিয়েছিলেন তিনি এবং রবীন দেব। বাস্তবে ঘটেছেও তা-ই! রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আর এক সদস্য রবীনবাবুকে (যিনি নিজে দু’বার মমতার বিরুদ্ধে লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়ে হেরেছেন) নিয়ে সেলিম তাঁর ‘কাজ’ করে এসেছেন! বৈঠকের অন্দরে এবং বৈঠকের শেষে প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীকে ঈষৎ ‘ক্ষুব্ধ’ই দেখিয়েছে।
আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর, এর আগে দু’টি সর্বদল বৈঠকে সূর্যবাবুকে পাঠিয়ে সিপিএম বুঝেছিল, তিনি ‘ঈপ্সিত’ কাজ করে উঠতে পারছেন না। দলের এক রাজ্যনেতার কথায়, “সূর্য’দা সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে মর্যাদাব্যঞ্জক ভাবে বৈঠক করছিলেন। মমতার মোকাবিলা করার জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল না।” বস্তুত, আগের সর্বদল বৈঠকে সূর্যবাবুর কথা ছিল আলোচ্যসূচিতে না-থাকলেও ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে আলোচনা তোলার। সূর্যবাবু তা সেভাবে করেননি। বৈঠকের পর মমতা তাঁকে আলাদা ডেকে নিয়ে নিজের ঘরে একান্তে বৈঠক করেছিলেন। তারপর দু’জনের হাস্যমুখের ছবি প্রকাশিতও হয়। রাজ্যের মানুষ তাকে ‘রাজনৈতিক সৌজন্য’ ভাবলেও সিপিএমের তাতে ‘খুশি’ হওয়ার কারণ ছিল না। ফলে এবার সেলিম।
বৈঠকে যত্রতত্র সভা-সমাবেশ বন্ধ করা নিয়ে অন্যরা ‘আপত্তি’ তুললে মমতার তরফে তাদের ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে প্রশ্ন
তোলারও অবকাশ থাকত। সে ক্ষেত্রে তৃণমূলের তরফে বলার সুযোগ থাকত যে, তারা আমজনতার হয়রানি বন্ধ করতে চাইলেও অন্যদের আপত্তিতে তা হল না! সিপিএম সেই বিষয়টিকেও গুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। তারা জানত, সিপিএমকে ‘একনম্বর শত্রু’ বলে মনে-করা মমতা সামান্য খোঁচাতেই ক্ষুব্ধ হবেন। তা-ও সেলিমের কাছ থেকে!
সেলিমকে পাঠিয়ে সিপিএম যে মমতাকে ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছে, তা কারও নজর এড়ায়নি। মহাকরণের সরকারি আধিকারিকদের মুখেও সেলিম-রবীনকে শুনতে হয়েছে, সূর্যবাবু আসবেন না? এমনকী, বৈঠকে সই-পর্বের সময়েও সেই প্রশ্ন! দলের একাংশ জানাচ্ছে, ‘মৃদুভাষী’ সূর্যবাবুকে পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আগের দুই সর্বদলে সহমতের ছবি দেখিয়ে যে ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ তুলেছিলেন, এ বার তা থেকে বেরোনোর জন্যই সেলিমকে এগিয়ে দিয়েছিল আলিমুদ্দিন। ঘনিষ্ঠ মহলে সূর্যবাবু অবশ্য বলেছেন, “আমি কলকাতার কী জানি! কোথায় সভা-সমাবেশ করবে যাঁরা জানেন, তাঁদেরই দল পাঠিয়েছে। এ নিয়ে জল্পনা অর্থহীন।” আর ঘনিষ্ঠ মহলে সেলিম বলেছেন, “দল যা ঠিক করে দিয়েছে, তা-ই হয়েছে।” তবে ইতিহাস বলছে, ইউপিএ-১ জমানায় বামেরা যখন কেন্দ্রে সমর্থক, তখনও কংগ্রেসকে ‘কড়া কথা’ বলার সময় সেলিমকেই এগিয়ে দেওয়া হত।
বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সর্বদল নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা বেরিয়েছে, তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যেন কিছু না-ভাবেন। গণতন্ত্রের ‘কণ্ঠরোধ’ করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য প্রথম তাঁদের আপত্তির কথা জানান। এর পরেই আসরে নামেন সেলিম। তিনি প্রশ্ন তোলেন বৈঠকের আলোচ্যসূূচিতে ‘অস্পষ্টতা’ নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী খানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে সেলিম খতিয়ান দেন, বাইপাসের ধারে কসবা থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত মোট ১,১১৭টি হোর্ডিং আছে। তার মধ্যে মাত্র ৬টি রাজনৈতিক। একটি কংগ্রেসের, বাকি ৫টিই তৃণমূলের! সেলিম বলেন, হোর্ডিং সরাতে কলকাতা পুরসভাই পারে। সেজন্য মুখ্যমন্ত্রীকে সর্বদল ডাকতে হয় না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-সন্ত্রাসের মতো জনতার জীবনের ‘জ্বলন্ত সমস্যা’ বা তিস্তার জলচুক্তি, জিটিএ চুক্তির মতো রাজ্যের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ প্রশ্নে সবর্দল না-করে সরকার তাদের ‘অগ্রাধিকার’ গুলিয়ে ফেলছে।
স্বভাবতই ‘রুষ্ট’ মমতা উত্তর দেন, পুরসভার বিষয়টা তাঁর মাথায় আছে। তাই কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে বৈঠকে থাকতে বলেছেন।
একদা মমতার জোটসঙ্গী এসইউসি-র সৌমেন বসু সরাসরি বলেন, সরকার যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, তা কোনও ‘বিষয়’ই নয়! সরকারকে বণিকসভার পাঠানো সুপারিশ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী সৌমেনবাবুকে সটান বলেন, এমন বৈঠকে ‘রাজনীতি’ না-করতে। রাজনীতি করতে গিয়ে বামফ্রন্ট রাজ্যের সর্বনাশ করেছে। এতে আবার রবীনবাবু আপত্তি জানান। তাতে বিতর্ক বাধে। আরএসপি-র মনোজ ভট্টাচার্য বলেন, আসল প্রশ্ন ছেড়ে সরকার শহরের রং, হোর্ডিং লাগানোর জায়গা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী শহরের কিছু ‘প্রসাধনী পরিবর্তন’ (কসমেটিক চেঞ্জ) আনতে চাইছেন। ‘কসমেটিক’ শব্দটিতে প্রবল আপত্তি করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মনোজবাবু ‘পলিটিক্সে’র সঙ্গে কেন ‘কসমেটিক্স’ জড়াচ্ছেন! ওই বক্তব্য তাঁকে প্রত্যাহার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মনোজবাবু বলেন, তাঁর বক্তব্য না-পাল্টেও ওই শব্দটি তিনি ‘প্রত্যাহার’ করে নিচ্ছেন!
বৈঠকের পরিবেশ এমনই ছিল, রবীনবাবু কিছু বলতে গেলে তাঁর হাত চেপে ধরেছেন এক বর্ষীয়ান মন্ত্রী! বাম প্রতিনিধিরা কী বলবন, তা ঠিক হয়ে গিয়েছিল এ দিন সকালে আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্ট বৈঠকে। সেই ‘চিত্রনাট্য’ অনুযায়ী তাঁরা ভূমিকা পালন করে এসেছেন!
বৈঠকের পরে দৃশ্যতই ‘ক্ষুব্ধ’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সিপিএম যে ভাষায় বলল, তাতে মনে হচ্ছে, এটাকে ওরা প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। আমরা কিন্তু তা চাইনি। তা হলে আমরা এক তরফা ভাবে অনেক কিছুই করতে পারতাম। মনে রাখবেন, বিধানসভায় তৃণমূল একাই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে তৃণমূল এক, কংগ্রেস দুই, সিপিএম তিন নম্বরে। বামফ্রন্ট দু’নন্বরও নয়! তা সত্ত্বেও আমি ওরা-আমরা চাই না। সৌজন্য, মর্যাদা দিয়ে ওদের আমরা ডেকেছি। যা করার করেছি।” সিপিএম যেন এই ‘সৌজন্য’কে ‘দুর্বলতা’ না-ভাবে, সে ব্যাপারেও তাদের ‘হুঁশিয়ার’ করে দিয়েছেন মমতা। বামফ্রন্টের একাংশ অবশ্য এতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘আমরা ২৩৫। ওরা ৩০। আমাদের কে রুখবে’-র ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। যার প্রতিবাদে তৃণমূল বলছে, “তা হলে কি আর মুখ্যমন্ত্রী সর্বদল ডাকতেন?”
মহাকরণ ছাড়ার আগেও সেলিম বলেন, “কলকাতাই রাজধানী, রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। তাই দাবি জানাতে সকলে এখানে আসে। তা না-পারলে গায়ে পেট্রোল ঢালা বা গাড়ির সামনে লাফিয়ে পড়ার সংখ্যা বাড়বে!” এই মন্তব্যে মমতার প্রতি ‘কটাক্ষ’ স্পষ্ট। ঘটনাচক্রে, সেলিম যখন ওই কথা সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, তখন ঠিক তাঁর পিছনেই দাঁড়িয়ে মমতা। সেলিম বলে চলেন, “তৃণমূলই তো প্রতি বছর ২১ জুলাই ধর্মতলা-বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড়ে সভা করত!”
যুক্তি-পাল্টা যুক্তির পর শেষ পর্যন্ত সরকারের তরফে সবক’টি দলের লিখিত মতামত চাওয়া হয়। পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি জোর করে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। তবে আমি মনে করি, মিছিল-সভা শনিবার করলে ভাল হয়। কারণ, ওই দিন ছুটি থাকে।” সিপিএমের সূত্রের খবর, সরকার নির্দিষ্ট ভাবে মেট্রো চ্যানেলে সমাবেশ বন্ধ করার প্রস্তাব দিলে তারা বিশেষ আপত্তি করবে না। কারণ, ২০০৩-এর ২৯ অক্টোবর বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সর্বদল বৈঠকে যে সাতটি স্থান কলকাতায় সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট করার লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে মেট্রো চ্যানেল ছিল না। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “সরকার তাদের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে জানালে তবেই আমরা মতামত দিতে পারি। তবে আমাদের পুরনো অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।”
এদিনের পর পরবর্তী দফার সর্বদল আলোচনা হয় কি না, তা-ই অবশ্য দেখার।
|
নগর-দর্শন |
সরকারের প্রস্তাব |
• ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে সভা নয় |
সভা হতে পারে |
• রানি রাসমণি রোড,
• সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার,
• শহিদ মিনার মাঠ ও মেয়ো রোডে গাঁধীমূর্তির পাদদেশ |
হোর্ডিং |
• রাজনৈতিক হোর্ডিং লাগানোর জন্য বৃহত্তর
কলকাতায় ১০টি এলাকা চিহ্নিত করে দেবে সরকার |
|