নদিয়ার রাজসিংহাসনে তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। বছরের বিশেষ কয়েকটা দিন আসেন নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে। তার মধ্যে রয়েছে এই দিনটিওপ্রতিপদে পিতৃপক্ষের সূচনালগ্ন। এই দিন থেকেই যে তাঁর গুরুগৃহে আরম্ভ হয় দুর্গাপুজোর। তারপরে টানা ২৩ দিন পরে দশমীতে প্রতিমার বিসর্জন। এই সময়টুকু ধরে চলে যাগ-যজ্ঞ-হোম। সাড়ম্বরে জগন্মাতার পুজোয় অর্থ ও ভক্তির এক মহোৎসব। হবে না-ই বা কেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গুরুবাড়ি বলে কথা।
মহারাজা স্বয়ং তাঁর মহিষীকে সঙ্গে নিয়ে এই দিনটিতে হাজির থাকেন গুরুবাড়ির পুজোয়। আর তার আগে আগে সেরে নেন নবদ্বীপের ঘাটের গঙ্গা স্নান। ফলে পিতৃপক্ষের এই প্রথম দিনটিতে নবদ্বীপেও পড়ে যায় সাজো সাজো রব। হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত। ঝকঝকে তকতকে ঘাট। ঝোপ জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছে। যত্ন করে নিকানো হয়েছে ঘাট। ফাঁকা জায়গায় কোথাও কোথাও রঙিন চাদর মেলা। যাঁর কিছু চাওয়ার আছে, তিনিও এসেছেন, যাঁর শুধুই দেখার রয়েছে, তিনিও এসেছেন। সামনেই প্রবাহিত ভাদ্রের ভরা গঙ্গাও যেন উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠেন।
এই এত কাণ্ডের পরেও, স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রের উপস্থিতিতেই নবদ্বীপ কিন্তু থাকে নবদ্বীপেই। নবদ্বীপের অন্য ঘাটগুলিতে তখন জলগদম্ভীর স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে মন্ত্র। সেখানেও উপচারের কোনও কমতি নেই। নবদ্বীপের বিখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিতেরা যে সেখানে এই দিনটিতেই শুরু করেছেন তাঁদের পিতৃতর্পণ। গঙ্গার অন্য ঘাটগুলিতে সে-ও এক তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য। পণ্ডিতদের ঘিরে রয়েছেন তাঁদের শিষ্যরা। এক টানা পনেরো দিন ধরে তর্পণ করার পরে মহালয়ার দিন থেকে জগদ্বিখ্যাত এই পণ্ডিতেরা সপার্ষদ বেরিয়ে পড়বেন যজমানদের বাড়ির পুজো করতে। ফিরতে ফিরতে দেবীপক্ষ এমনকী দীপাবলিও পেরিয়ে যাবে। তারপরে তাঁরা নিজেদের বাড়িতে করবেন রাসের উৎসব। তাই তখনকার দিনেও নবদ্বীপে লোকচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হত এই দিনটিতে। কিন্তু মহারাজের সঙ্গেই আসতেন বহু লোক। আসতেন নানা জমিদার, সামন্ত, সম্পন্ন বণিক। পণ্ডিতদের ছাত্রেরা। তাই মানুষে মানুষে মেলা বসে যেত দিনটিতে। এই দিনটিতেই, শোনা যায়, কোন পণ্ডিত এ বার কোথায় পুজো করবেন, তা-ও ঠিক হত। পণ্ডিতেরা যতই পণ্ডিত হোন, দর কষাকষিতেও সমান দড়। রফা চূড়ান্ত হলে পণ্ডিতমশাই নিজেই সেই নথিতে সিলমোহর দিয়ে দেবেন।
এই ভাবেই পিতৃপক্ষের প্রথম দিনটিতে শুরু হয়ে যেত দুর্গাপুজোর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। গঙ্গা দিয়ে তারপরে অনেক জল গড়িয়েছে। সেই রীতি এখনও টিমটিম করে রয়ে গিয়েছে। নবদ্বীপে এখনও ভাদ্র প্রতিপদ তিথি আর ক’টা সাধারণ দিনের থেকে আলাদা। বঙ্গীয় পুরোহিত সভার নবদ্বীপ অঞ্চলের সভাপতি এবং প্রবীণ পুরোহিত সত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মানুষ মনে রেখেছেন, আগে এই দিনে বাহিরগাছিতে নদিয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গুরুবাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনাও হত, তবে সে আর এখন হয় না।” প্রাক্তন শিক্ষক শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “এই দিন থেকে তর্পণের শুরু। এটাই রীতি। পনেরো দিন ধরে পূর্বপুরুষদের জলদান করতে হয়। এখন তা ছোট করে দেওয়া হয়েছে। তবে নৈয়ায়িকদের পীঠস্থান নবদ্বীপে এখনও এই দিনে সেই রীতি অল্প হলেও মানা হয়।” |