জোকারের শাসন বছর দুই চলবেই |
জয়দীপ মুখোপাধ্যায় |
নোভাক জকোভিচ এ বছর চারটের মধ্যে তিনটে গ্র্যান্ডস্লাম জেতায় বলতেই হচ্ছে, ‘হি হ্যাজ গট হিজ নাম্বার’। অর্থাৎ জকোভিচ ওর প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছে। গত বারো মাসে বছর চব্বিশের সার্ব ছেলেটা টেনিস খেলাটার সর্ব অর্থেই নিজের যে রকম অসাধারণ উন্নতি ঘটিয়েছে, স্রেফ ভাবা যায় না! সোমবার গভীর রাতে চার ঘণ্টা ১০ মিনিটের ম্যারাথন ফাইনালে রাফায়েল নাদালকে ৬-৪, ৬-২, ৬-৭ (৩-৭), ৬-১ হারিয়ে ‘জোকার’ জকোভিচের যুক্তরাষ্ট্র ওপেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ২০১১-এ ওর অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা। চারটের মধ্যে তিনটে গ্র্যান্ডস্লাম চ্যাম্পিয়ন। সঙ্গে আরও সাতটা এটিপি খেতাব। তার মধ্যে আবার পাঁচটাই মাস্টার্স সিরিজপেশাদার সার্কিটে গ্র্যান্ডস্লামের পরেই যে টুর্নামেন্টের গুরুত্ব। এক বছরে এতগুলো মাস্টার্স আগে কেউ জেতেনি। সব মিলিয়ে এ বছর ৬৪ ম্যাচে ৬২টা জিতেছে। সাফল্যের পারসেন্টেজ ৯৬.৯৭। আগে কেউ যা দেখাতে পারেনি। জন ম্যাকেনরো শুনলাম বলেছে, “আমাদের খেলাটার ইতিহাসে জকোভিচের এই মরসুমটাই সর্বকালের সেরা।” একদম ঠিক কথা। |
|
শীর্ষে: যুক্তরাষ্ট্র ওপেনেও বাজিমাত। ট্রফি নিয়ে নিউ ইয়র্কের
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ে নোভাক জকোভিচ। মঙ্গলবার। |
কথাটা ম্যাকেনরো বলেছে বলেই আরও বেশি গুরুত্বের। কারণ ১৯৮৪-তে ওরও মরসুমটা অবিশ্বাস্য গিয়েছিল। জয়-হারের হিসেব ছিল ৮২-৩। দুটো গ্র্যান্ডস্লাম-সহ ১৪টা টুর্নামেন্ট জিতেছিল সে বছর। কিন্তু জকোভিচের গ্র্যান্ডস্লাম জেতার সংখ্যা ২০১১-এ আরও বেশি। সাফল্যের পারসেন্টেজেও এগিয়ে আছে ম্যাকেনরোর থেকে। নাদাল যে নাদাল, তাকে পর্যন্ত ছ’বারে ছ’বারই হারাল। রজার ফেডেরারের বিরুদ্ধে মুখোমুখিতে এ বছর জকোভিচ এগিয়ে ৪-১। অ্যান্ডি মারের সঙ্গে লড়াইয়ে এগিয়ে ২-১। তার মানে বিশ্বের দুই-তিন-চার নম্বরের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধে এক নম্বর অনেক এগিয়ে। তা-ও মারের কাছে সিনসিনাটি মাস্টার্স ফাইনালে চোটের জন্য মাঝপথে ওয়াকওভার দিয়েছিল জকোভিচ। পূর্ণাঙ্গ ম্যাচ গোটা বছরে একটাই হেরেছেফরাসি ওপেন সেমিফাইনালে ফেডেরারের কাছে। যার বদলা ফ্লাশিং মেডোয় সুদে-আসলে তুলেও নিয়েছে। দু’সেট পিছিয়ে পড়েও ৩-২-এ ম্যাচ জিতে। |
|
চ্যাম্পিয়নের উল্লাস। সোমবার ফ্লাশিং মেডোয়। |
আসলে আর ফেডেরার, মারে-টারের বিরুদ্ধে নয়। বিশ্ব টেনিসের এখন ‘সামিট ম্যাচ’ একটাইনোভাক বনাম রাফা। টেনিস-গ্রহের সেরা বিনোদন এখন এই লড়াইটাই। তো সেটাও যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ফাইনালে দেখলাম একপেশে করে দিল জকোভিচ। প্রথম দু’টো সেটে নাদাল প্রায় দাঁড়াতেই পারেনি। তৃতীয় সেট গত বারের চ্যাম্পিয়ন জিতলেও সেটা জিতেছে প্রতিপক্ষের অসুস্থতার জন্যই। খেতাব থেকে মাত্র দু’পয়েন্ট দূরে থাকা অবস্থায় হঠাৎ পিঠে চোট পেয়ে বসে জকোভিচ। টাইব্রেকারে তৃতীয় সেট হারার পরে কোর্টেই ডাক্তার ডেকে এনে শুশ্রূষা করাতে হয়। তার পর ফের তেড়েফুঁড়ে খেলে চতুর্থ সেটে নাদালকে ৬-১ উড়িয়ে দিল। ওই সেটে বরং নাদালকেই দেখে মনে হচ্ছিল, কোর্টে দৌড়তে পারছে না! যেন আগের সেটে ওরই পিঠে চোট লেগেছে! এটা আসলে এক জন চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী প্লেয়ারের সঙ্গে এক জন মানসিক ভাবে ভঙ্গুর প্লেয়ারের তফাত। আমার মতে নাদালের সামনে জকোভিচ এখন একটা মানসিক বাধা বা ‘মেন্টাল ব্লক’ হয়ে উঠেছে। টানা আধ ডজন ম্যাচ ওর কাছে হারার ফলে। নইলে নাদালের মতো ডাকাবুকো ছেলে কখনও ফাইনালের আগে প্রকাশ্য প্রেস কনফারেন্সে বলে দিত না, “নোভাকই ফেভারিট। যা খেলছে ও!” এটা কিন্তু চিরাচরিত বড় ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষকে এগিয়ে রেখে তার ওপর মানসিক চাপ তৈরির ব্যাপার নয়। নাদাল মনে হয় কথাটা নিজে বিশ্বাস করে বলেই বলেছিল। আর উল্টো দিকে জকোভিচ ইদানীং কোনও পরিস্থিতিতেই যেন বিশ্বাস করতে পারে না যে, ও ম্যাচে হারতে পারে! স্কিল আর টেম্পারামেন্ট কোন উচ্চতায় পৌঁছলে এক জন প্লেয়ারের এ রকম মানসিকতা হয়! যার জোরে ও ফেডেরারেরও বিরুদ্ধে কার্যত হারা ম্যাচ জিতেছিল দিন দুয়েক আগেই। কোর্টে নিজেকে সম্পূর্ণ নিংড়ে দিয়ে পাঁচ সেটের ও রকম একটা উত্তেজক লড়াই জেতার দেড় দিনের মধ্যে নাদালের সঙ্গে ফাইনাল! ভেবেছিলাম ফাইনালে ফিটনেসে জকোভিচই পিছিয়ে থাকবে। বাস্তবে দেখলাম ঠিক উল্টোটাই। |
|
নানা মেজাজে জকোভিচ। সোমবার ফ্লাশিং মেডোয়। |
অসাধারণ গ্রাউন্ডস্ট্রোক। ভয়ঙ্কর সার্ভিস। দ্বিতীয় সার্ভেও সফল হওয়ার দুর্দান্ত পারসেন্টেজ। প্রতিপক্ষকে কোর্টের এক কোণ থেকে আর এক কোণে সারাক্ষণ ছুটিয়ে মারার অনবদ্য ক্ষমতাজকোভিচকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। নাদালকে টানা এত বার হারানোর রহস্যকোর্টে ওকে ওর পছন্দের বেসলাইনের বাঁ দিকের কোনাকুনি জায়গাটা থেকে বার করে আনতে পারা। যেখান থেকে নাদাল ওর অসাধারণ ফোরহ্যান্ডে ম্যাচকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জকোভিচ নিজের ব্যাকহ্যান্ডের অসাধারণ উন্নতি ঘটিয়ে বলগুলো কোর্টের এমন জায়গায় বেশির ভাগ সময় এখন রাখছে যে, নাদালকে বাধ্য হয়ে বেসলাইনের মাঝামাঝি জায়গায় এসে রিটার্ন মারতে হচ্ছে আর তাতে ম্যাচের ওপর নিজের আগের সেই নিয়ন্ত্রণটা থাকছে না।
সাধে কি আর নাদাল বলেছে, “নোভাকের কীর্তি ভবিষ্যতে এক মরসুমে ভাঙা অসম্ভব!” এটাও সর্বৈব সত্য। কোর্টেই মজা করার জন্য সার্কিটে জকোভিচ ‘জোকার’ নামে জনপ্রিয়। বিশ্ব টেনিসে জোকারের শাসন আরও দু’তিন বছর চলবেই। তার বেশি আমি দেখছি না, কারণ জকোভিচ-নাদালরা বড্ড বেশি শরীর দিয়ে টেনিসটা খেলে। ফেডেরারের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ ফিটনেস সেই পর্যায়ে নয়। চোটআঘাতের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। সাতাশ-আঠাশের বেশি এহেন স্বপ্নের ফর্ম টানা সম্ভব নয়!
|
ছবি: এএফপি |
|