আত্মহত্যার চেষ্টা মহাকরণের সামনে
এসেছে নয়া সরকার, তাই বাছলাম এই জায়গাটাই
কারও একটা চাকরি চাই! কেউ সহ্য করতে পারছেন না চুরির ‘মিথ্যা অপবাদ’!
মুশকিল আসান এক জন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেউ ছুটে আসছেন তাঁর চলন্ত গাড়ির জানলায়। কেউ স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মহাকরণের সেন্ট্রাল গেটের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন।
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে এক জনের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অঘটন ঘটার আগেই পুলিশের হাতে তাঁরা ধরা পড়েন। মুখ্যমন্ত্রী মমতার নির্দেশে ছাড়াও পেয়ে যান। কিন্তু তাতে ভবি ভোলে না। পুলিশ এবং নিরাপত্তা কর্মীরা উদ্বেগে থাকেন, কবে আবার ঘটবে এমন ঘটনা।
যেমন ঘটল মঙ্গলবার ভরদুপুরে। মহাকরণের সামনে। উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের বাসিন্দা এক দম্পতি গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গায়ে পেট্রোল ঢেলে ফেললেও শেষ পর্যন্ত আগুন লাগানোর আগেই পুলিশ তাঁদের ধরে ফেলে।

সঞ্জীব পাল

শিল্পা পাল
কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহাকরণে আসার পথে উত্তর ২৪ পরগনারই বারাসতের বাসিন্দা এক যুবক দৌড়ে এসেছিলেন তাঁর গাড়ির জানলায়। তাঁর দরকার ছিল একটা চাকরির। ঈষৎ মানসিক ভারসাম্যহীন ওই যুবক তার আগেও মমতার বাড়ির কাছের একটি বাড়ির দেওয়ালে মাথা ঠুকে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছিলেন। মমতার নির্দেশেই তাঁকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। যেমন ছেড়ে দিয়েছে এ দিন আত্মহত্যার চেষ্টাকারী ওই যুবক এবং তাঁর স্ত্রীকে। যে যুবক এর আগে তাঁর প্রাক্তন মালিককে গিয়ে খুনের হুমকি দিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে চুরির ‘মিথ্যা অপবাদ’ দেওয়ার প্রতিবাদেই।
কেন সঞ্জীব পাল নামে ৩২ বছরের ওই যুবক স্ত্রী শিল্পা এবং দেড় মাসের শিশুকন্যা সাথীকে নিয়ে আত্মহত্যার জন্য মহাকরণের ভিভিআইপি এলাকাকে বেছে নিলেন?
পুলিশকে সঞ্জীববাবু জানিয়েছেন, রাজ্যে নতুন সরকার এসেছে। তাই ওই জায়গাটিকেই তাঁরা আত্মহত্যার জন্য বেছে নিয়েছিলেন।
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থাৎ, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই রোজ তাঁর বাড়ির সামনে বিভিন্ন ধরনের আর্জি নিয়ে শত শত মানুষের ভিড় হয়। রবিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতি দিনই তাঁরা মমতার সঙ্গে দেখা করতে চান। রবিবার মুখ্যমন্ত্রী সাধারণত ঘরের বাইরে বেরোন না। ওই দিন দর্শনার্থীদের সামলান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর বাড়ির সামনে লাগাতার ওই ভিড় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ঈষৎ ক্ষুণ্ণ। এ দিনের ঘটনাতেও তিনি যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। সন্ধ্যায় মহাকরণ ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মমতা বলেন, “পুলিশকে জিজ্ঞেস করুন।” তার পরেই তিনি বলেন, “কেউ যদি ধরে এনে করায়, আমার কী করার আছে?”
দলের ‘কট্টর’ অংশের মতে, সিপিএমের তরফে ‘গোলমাল পাকাতে’ এমন লোকজনকে পাঠানো
হচ্ছে। আর বাস্তববাদী অংশের অভিমত, মমতা যে হেতু ‘জননেত্রী’ ও ‘জনতার মুখ্যমন্ত্রী’, এবং অতীতে নিরাপত্তা কর্মীদের আপত্তিকে আমল না-দিয়ে জনতাকে তিনি কাছে আসতে দিয়েছেন, তাদের অভাব অভিযোগের কথা শুনেছেন, তাই জনতারও তাঁর উপর একটা ‘দাবি’ ও ‘বিশ্বাস’ জন্মেছে যে, তিনিই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন! সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, “মমতা বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাস করেন না। অন্য মন্ত্রীদের গুরুত্ব দেন না! জেলা স্তরে তো বটেই, রাজ্য স্তরেও তাঁর কাছে গেলেই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে ভেবেই লোকে মমতার পিছনে দৌড়চ্ছে!”
প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, আমজনতার মধ্যে এই ‘ধারণা’ ক্রমশ বিপজ্জনক প্রবণতার দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ‘দৃষ্টি আকর্ষণ’ করা যদি সঞ্জীবের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে তিনি যথেষ্ট ‘সফল’। সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দী যেমন বলেছেন, “সমাজ যখন ধাক্কা মারতে মারতে মানুষকে মাটিতে ফেলে দেয় বা তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়, তখনই সে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে।”
এ দিন বেলা সওয়া তিনটে নাগাদ ঘটনাটি ঘটে। তখন মহাকরণের সামনের ফুটপাথে সাদা পোশাক-সহ পুলিশের অনেকেই ডিউটিতে ছিলেন। ছিলেন কিছু পথচারীও। আচমকা মহাকরণের উল্টোদিকের ফুটপাথে একটি গাছের সামনে এসে দাঁড়ান পাল দম্পতি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সঙ্গে আনা একটি জ্যারিকেন থেকে নিজেদের গায়ে পেট্রোল ঢেলে দেন। বাচ্চাটির গায়ে তখনও পেট্রোল ঢালা হয়নি। দূর থেকে ওই দৃশ্য দেখে লোকেরা চিৎকার করে ওঠে। পুলিশের কয়েক জন দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরেন ওই দম্পতিকে। তাঁরা তখনও দেশলাই ঠুকে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
দু’জনকে পুলিশ মহাকরণে ওসি-র ঘরে নিয়ে যায়। জেরায় তাঁদের নামধাম জানা যায়। সঞ্জীব পুলিশকে জানান, তাঁদের বাড়ি ব্যারাকপুরের মাঠপাড়ার জগদীশ সরণি ফার্স্ট লেনে। সিঁথির মোড়ে এক গয়নার দোকানে তিনি কাজ করতেন। ‘চুরির অপবাদ’ দিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করেন দোকানের মালিক গৌতম চক্রবর্তী। মিথ্যা অপবাদের হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
দোকান-মালিক গৌতমবাবুর অবশ্য দাবি, আগেও এক বার সপরিবার ‘আত্মহত্যা’র হুমকি দিয়েছেন সঞ্জীব। গৌতমবাবু বলেন, “মাত্র ছ’মাস সঞ্জীব আমার দোকানে কাজ করেছিল। তার মধ্যেই প্রায় ২৩৭ গ্রাম সোনার হিসেব দিতে পারেনি। তাই বছর খানেক আগে ওকে সরিয়ে দিই।” তাঁর অভিযোগ, “ফের কাজে নেওয়ার জন্য সঞ্জীব আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। বিষয়টি জানিয়ে আমি সিঁথি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি।” পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বারবার দোকানের সামনে এসে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে গৌতমবাবু ফৌজদারি আইনের ১০৭ ধারায় সঞ্জীবের বিরুদ্ধে শিয়ালদহ আদালতে মামলা করেন। গত মাসে পুলিশের পাঠানো রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বিচারক সঞ্জীবকে শো-কজ করেন। পুলিশের অনুমান, এর পরে ভয় পেয়ে সঞ্জীব ওই দোকানের সামনে যাননি।
ব্যারাকপুরে সঞ্জীবের বাড়িতে বাবা-মা, দুই ভাই থাকলেও এক ছাদের নীচেই তাঁর আলাদা সংসার। মহাকরণের সামনের ঘটনার কথা বিকেল পর্যন্ত জানতেন না বাড়ির কেউ। সংবাদমাধ্যম বাড়িতে হাজির হওয়ায় হকচকিয়ে যান সঞ্জীবের মা অঞ্জলিদেবী। তিনিও বলেন, ‘‘মিথ্যা অপবাদে কাজ হারিয়ে সঞ্জীব হতাশ হয়ে পড়েছিল। তার পরে ট্রেন দুর্ঘটনায় অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা।’’ প্রসঙ্গত, চাকরি যাওয়ার পর দমদম স্টেশনে ট্রেনের ধাক্কায় গুরুতর জখম হন সঞ্জীব। তার পরে বাড়িতেই শয্যাশায়ী ছিলেন। দম্পতির আত্মহত্যার চেষ্টার খবর যায় মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে। তাঁর সচিবালয় থেকেই পুলিশকে বলা হয়, মুচলেকা নিয়ে ধৃতদের ছেড়ে দিতে। সেই মতো সন্ধ্যায় সঞ্জীবদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মহাকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ অফিসার বলেন, “যে দোকানে তিনি কাজ করতেন, তার মালিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানা কথা বলবে। সঞ্জীববাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে ফের তাঁকে কাজে বহাল করার অনুরোধ জানানো হবে।” সঞ্জীবের পরিবারের দাবি, তৃণমূলের স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়ে তিনি বহু বার কাজ পাইয়ে দেওয়ার আর্জি জানাতেন। এ দিন ঘটনার কথা জানার পরে সঞ্জীবের বাড়িতে যান ব্যারাকপুর পুরসভার চেয়ারম্যান উত্তম দাস। সঞ্জীব ফিরলে তাঁর একটা কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা দেখার আশ্বাসও দেন তিনি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.