হাতে দা ও কাঁধে এক গাছি দড়ি নিয়ে ‘নারকেল গাছ ঝাড়াবেন নাকি বাবু’ হাঁক পাড়তে পাড়তে চলে যাওয়া লোকটিকে দেখে বোঝা সম্ভবই নয় যে তাঁর মন প্রতিনিয়তই সুরের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তবে কাজে বের হলেও সঙ্গের ছোট্ট বাঁশের বাঁশিটি তাঁর নিত্যসঙ্গী। গাছ ঝাড়ার (গাছের ডালপালা ছাঁটা) কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তখন হাতে উঠে আসে বাঁশি। সুরের প্রলেপে দূর হয়ে যায় সারাদিনের ক্লান্তি। শুধু নিজের জন্যই নয়, তাঁর বাঁশির সুর টেনে ধরে পথচলতি মানুষকেও। এক দিনমজুরের মুখের বাঁশির করুণ সুর অবাক করে দেয় মানুষজনকে।
উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার ঠাকুরনগর-চিকোনপাড়ায় বাড়ি বাঁশিওয়ালা অসিত মিস্ত্রির। পেটের তাগিদে বছর তেত্রিশের যুবকটিকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাছ ঝাড়ার কাজ করতে হলেও তাঁর মনের খিদে মেটায় বাঁশের তৈরি ছোট্ট বাঁশি। দিবা-রাত্র বাঁশিই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। না, আর পাঁচজন শিল্পীর মতো পারিবারিক কোনও পরম্পরার পথ বেয়ে বাঁশির প্রেমে পড়েননি এই শিল্পী। বাঁশির প্রতি তাঁর ভালবাসার টান এসেছে একটু অন্য পথ বেয়েই। শিল্পীর মুখেই শোনা গেল সেই ইতিহাস, “বয়স তখন ১০ বছর। একদিন স্বপ্নের মধ্যেই শুনতে পাই বাঁশির সুর। মনে হল আমাকে কেউ বাঁশির সুর তুলতে বলছেন। সেই শুরু।” |
এর বছর দুয়েক পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে কাকার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন চলছিল সুন্দরবন মেলা। মেলা থেকেই জীবনের প্রথম বাঁশিটি কিনেছিলেন অসিতবাবু। নিজের খেয়ালেই বাঁশিতে সুর লাগাতেন। অভাবের সংসার। বাবা নকুলবাবু ছিলেন খেতমজুর। ডাঁয়ে আনতে বাঁয়ে টান পড়ে। তিনভাইকে নিয়ে নিয়ে অভাবের সংসারে পড়াশোনার চিন্তা ছিল বিলাসিতা। তাই সে দিকে আর যাওয়া হয়নি। সংসারের জোয়াল টানতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন দা আর দড়ি। জীবন সংগ্রামের সেই শুরু। তবে হাজারো ঘাত-প্রতিঘাতেও বাঁশির সঙ্গে সখ্যতা টুটে যায়নি। এ ভাবেই চলছিল। একদিন হাবরার প্রফুল্লনগরে কাজের মধ্যেই কানে ভেসে এল বাঁশির মিষ্টি সুর। কাজ শেষ করেই ছুটলেন সুরের সন্ধানে। পৌঁছে গেলেন কাছেই অশোক চক্রবর্তীর বাড়ি। সেখানে তখন বাঁশির ক্লাস নিচ্ছিলেন তিনি। আগন্তুককে দেখে তাঁর প্রশ্ন ছিল ‘‘কি চাও?” বাঁশি শিখতে চাই, ঝটিতি জবাব দিয়েছিলেন অসিত। একটু পরে ফের জানিয়েছিলেন, তাঁরা অত্যন্ত গরিব। তাই শেখার জন্য কোনও পয়সা দিতে পারবেন না। এমন শিষ্যকে ফেরাতে পারেননি অশোকবাবু। শুরু হয় তালিম। যা আজও চলছে। অশোকবাবুর যোগ্য এই শিষ্যটি অবশ্য ইতিমধ্যেই নানা জায়গায় তাঁর গুরুর মর্যাদা রেখেছেন। অসিতবাবুর বাঁশি বেজেছে রবীন্দ্রসদনে, সায়েন্সসিটি অডিটোরিয়ামে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলাতেও অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। পেয়েছেন বহু গুণীজনের প্রশংসা। তবে সে সব কথা বলতে একটু কুণ্ঠিতই হয়ে পড়েন শিল্পী।
বাঁশি শিখতে শিখতেই ভালবেসে ফেলেছেন বাঁশি তৈরিকেও। বাঁশি বাজানোর পাশপাশি এখন বাঁশি তৈরি করে বিক্রিও করেন অসিতবাবু। বিখ্যাত বাঁশিশিল্পী হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার ভক্ত অসিতবাবুর বাঁশিতে কখনও বেজে ওঠে ভাটিয়ালি, কখনও বাউল, পল্লিগীতি আবার কখনও ভাওয়াইয়ার সুর। পাশাপাশি সমানে চলে বিভিন্ন রাগসঙ্গীতের চর্চাও। আর এ কাজে দোসর হিসাবে পেয়ে গিয়েছেন স্ত্রী শ্যামলীদেবীকে। নিজে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও তাঁর স্বপ্নের বাঁশি তিনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন শিল্পীর একটাই স্বপ্ন। বাঁশি শেখানোর একটি স্কুল তৈরি করা। যার মাধ্যমে সুরে ভুবন ভরিয়ে দেবেন তিনি। |