|
|
|
|
হাইকোর্টই অরক্ষিত, বিস্ফোরণে হত ১১ |
অগ্নি রায় ও প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
ইঙ্গিত মিলেছিল তিন মাস আগেই।
গত ২৫ মে হাইকোর্টের গাড়ি রাখার জায়গায় একটি কম মাত্রার বিস্ফোরণ হয়েছিল। গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই ভাবেই সে দিন আদালত চত্বরে নিরাপত্তার জোর কতটা, মেপে গিয়েছিল জঙ্গিরা। আর তারই ‘ফল’ আজ বোঝা গেল সকাল ১০টা ১৪ মিনিটে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারালেন কমপক্ষে ১১ জন। আহত আরও অন্তত ৭৬। যাঁদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর অবস্থায়। তাই আশঙ্কা, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ-কে।
যখন সংসদ চলছে (যে সময়টায় দিল্লি জুড়ে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি থাকে, অর্থাৎ কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রাখার কথা রাজধানীকে), যখন ঢাকায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিয়ে যৌথ লড়াইয়ের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, ঠিক সেই সময়টাকেই হামলার জন্য বেছে নিল জঙ্গিরা। বিস্ফোরণের পরেই অভিযোগের আঙুল উঠল হরকত-উল-জিহাদি-আল-ইসলামির (হুজি) দিকে। বিস্ফোরণের পরে হুজি সংবাদমাধ্যমের দফতরে মেল পাঠিয়ে এই ঘটনার দায় স্বীকার করে। সেই বার্তায় আরও বলা হয়, আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রাখার প্রতিবাদেই এই বিস্ফোরণ। প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর খোদ সংসদ ভবনে জঙ্গিরা যে হানা দিয়েছিল, সেই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হন আফজল গুরু। |
|
বিস্ফোরণে আহতের সঙ্গে রাহুল গাঁধী। নয়াদিল্লিতে। |
এই বিস্ফোরণের পরে প্রশ্ন উঠেছে, মে মাসে হাইকোর্টে বিস্ফোরণ, জুলাইয়ে মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরেও কেন টনক নড়ল না সরকারের? কেন এখনও সিসিটিভি নেই আদালতে, কাজ করে না মেটাল ডিটেক্টর বা স্ক্যানার?
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, জুলাইয়ে মুম্বই বিস্ফোরণের মতো এ দিনও ছিল আর একটা বুধবার। এই দিনটাতেই আরও এক বার প্রমাণ হয়ে গেল, দেশের রাজধানী শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জায়গায় জায়গায় কতটা ঠুনকো। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ দিনই সংসদে জানিয়েছেন, দিল্লি পুলিশকে জুলাই মাসেই সতর্ক করা হয়েছিল। অনেকে মনে করছেন, এই ভাবে শীলা দীক্ষিত সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ও এই ধরনের চাপানউতোরের সম্ভাবনায় সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু ঘটনা হল, দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরই অধীন। তাই, গলদের পিছনে চিদম্বরমের মন্ত্রকের দায় থেকেই যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে কিছু ফাঁকফোকর রয়েছে, সে কথা প্রধানমন্ত্রীও প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন। |
|
আজ ছিল জনস্বার্থ মামলার দিন। এই দিনে আদালত চত্বরে ভিড় হয় অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। তার উপরে পাশের চার নম্বর গেটটি বন্ধ থাকায় এবং তার কাছে মাটি খুঁড়ে গাড়ি রাখার জায়গা তৈরির কাজ চলায় পাঁচ নম্বর গেটের কাছের জায়গাটি কমে গিয়েছে। ফলে রিসেপশন অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইনটিতে তখন যথেষ্ট ঠাসাঠাসি। সাড়ে দশটায় আদালতের কাজ শুরু হয়। তাই তার ঠিক আগে এলাকায় ভিড় থাকে সব থেকে বেশি।
ঠিক এই সময়েই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পিইটিএন-সহ (পেন্টাইরিথ্রিটল টেট্রোনাইট্রেট বা এক ধরনের প্লাস্টিক বিস্ফোরক) দু’কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বোঝাই স্যুটকেসটি রেখে চলে যায় জঙ্গি বা জঙ্গিরা। এবং বিনা বাধায়। যার ধাক্কায় ৩ ফুট চওড়া এবং ১ ফুট গভীর গর্ত হয়ে গিয়েছে বিস্ফোরণস্থলে। যে ৭৬ জন গুরুতর আহত হয়ে ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে, তাঁদের মধ্যে ৫১ জনের জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে। অন্তত দু’জন লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। প্রত্যক্ষদর্শীরা মনে করছেন, ভাল করে এলাকা পরীক্ষা করে তবেই হামলার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। |
|
দিল্লি হাইকোর্টে আজকের বিস্ফোরণের দায়
আমাদের...আফজল গুরুর ফাঁসি অবিলম্বে বাতিল না
করলে ভবিষ্যতে দেশের প্রধান প্রধান হাইকোর্ট
এবং সুপ্রিম কোর্টও আমাদের নিশানা হবে...।
হরকতউলজিহাদি২০১১@জিমেল.কম |
|
বিস্ফোরণের পরে হুজি দায় স্বীকার করলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, বিস্ফোরকের ধরন দেখে বোঝা কঠিন, এর পিছনে কোন জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। তবে দিনভর প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলার পরে বিকেলে দুই সন্দেহভাজনের স্কেচ প্রকাশ করে দিল্লি পুলিশ। এক জনের আনুমানিক বয়স ২৫ বছর, আর এক জনের ৫০। দিনভর ঘটনাস্থল এবং নিকটবর্তী রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে (সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয় আহতদের) গেলেন সরকার ও কংগ্রেসের কর্তারা। সেই দলে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম, ছিলেন এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক রাহুল গাঁধী। রাতে ঢাকা থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে দেখা করেন। |
সন্ত্রাস দমনে আমাদের প্রচেষ্টার মধ্যে ফাঁকফোকর থেকে গিয়েছে। জঙ্গিরা তার সুযোগ নিচ্ছে। এই সব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আরও খাটতে হবে: মনমোহন সিংহ |
|
কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটাকেই ‘বিস্ফোরণের পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা’ বলে দেখছেন অনেকে। আর তাই রাহুলকেও শুনতে হল ‘হায় হায়’ আওয়াজ। রাতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ যখন রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে যান, তখন তাঁকে নিহতদের আত্মীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। তাঁরা দশ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়েও দেহ পাননি। এ ছাড়া অল্প কয়েক জন (যাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল) রয়েছেন সফদরজঙ্গ হাসপাতালে এবং এইমসে। সন্ধ্যায় আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। আহতদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথাও বলেন তিনি।
বিরোধীরাও প্রথমে ‘সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে একজোট’ হওয়ার কথা বলে পরে সরকারের বিরুদ্ধে জোরকদমে নেমে পড়ে। তাদের প্রশ্ন, এই একই জায়গায় যখন গত মে মাসেই বিস্ফোরণ হয়েছে, যেখানে জুলাইয়ে আবার আক্রান্ত হয়েছে মুম্বই, সেখানে সরকার হাত গুটিয়ে বসেছিল কেন?
২৫ মে দিল্লি হাইকোর্টের গাড়ি রাখার জায়গায় যখন কম মাত্রার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, প্রকাশ্যে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়নি সরকার। এখন ফের একই এলাকায় বিস্ফোরণের পরে মনে করা হচ্ছে, আদালত চত্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতখানি মজবুত, তা মাপতেই আগের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। আজকের বিস্ফোরণের সঙ্গে তাই ২৫ মে-র বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তের ভারও এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আগের ঘটনার পরেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার যে বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি, তা মেনে নিয়ে দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল কমিশনার ধর্মেন্দ্র কুমার জানিয়েছেন, রিসেপশনের বাইরে ওই এলাকায় যাঁরা প্রবেশপত্র
নেওয়ার জন্য যাঁরা আসতেন, তাঁদের শরীর বা জিনিসপত্র তল্লাশি করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না কোনও সিসিটিভি-ক্যামেরাও। |
|
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে, তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ২০ জনের বিশেষ টিম তৈরি করে তদন্তে নেমেছে এনআইএ। দিল্লির বেসরকারি অতিথিশালা, হোটেল, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে তল্লাশি শুরু হয়। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত কোনও গুরুত্বর্পূণ সূত্রের সন্ধান মেলেনি। দিল্লির সমস্ত প্রবেশপথে নজরদারি বসানো হয়েছে। সূত্রের খোঁজে দিল্লির আশেপাশের রাজ্যগুলিকেও সন্ত্রাসদমন বাহিনীর দল রাজধানীতে পাঠাতে বলা হয়েছে।
|
ছবি: পিটিআই, এপি |
|
|
|
|
|