|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
বিবেক অর্থ বিবেচনা |
বাংলায় আরও অনেক শব্দের ন্যায় ‘বিবেক’ শব্দটিও নানার্থবোধক। সেই অর্থগুচ্ছেরই অন্যতম ‘বিবেচনা’। বঙ্গীয় শব্দকোষ মতে ‘কার্য্যাকার্য্য’জ্ঞান অর্থে ‘বিবেচনা’। বালির যে দমকলকর্মীরা দুর্ঘটনাক্রমে নর্দমায় পতিত এক মুমুর্ষূ যুবকের কথা শুনিয়াও সাহায্য করিতে চাহেন নাই, তাঁহাদের আচরণ ঠিক কী পরিমাণ ‘অ-মানবিক’, তাহা নির্ণয় করিবার বিভিন্ন অনুভবগম্য মাপকাঠি আছে নিশ্চিত, কিন্তু তাঁহারা আভিধানিক অর্থে ‘বিবেক’হীন, সন্দেহ নাই। কারণ, কার্য এবং অ-কার্যের মাপকাঠিটি তাঁহাদের নিকট গুলাইয়া গিয়াছে। তাঁহারা নিজে সাহায্য করিতে যান নাই। যে সকল সহৃদয় ব্যক্তি যুবকের উদ্ধারকর্মে প্রয়াসী হইয়াছিলেন, তাঁহাদের সদুপদেশ দিয়াছেন, অবিলম্বে সরিয়া পড়ুন, কারণ ‘পুলিশ কেস’-এ জড়াইয়া না-পড়াই শ্রেয়। শলাটি দুই অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। একটি প্রশ্ন মানবিকতার। চক্ষুর সমীপে এক অসহায় ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছেন, অথচ সেই দৃশ্য দেখিয়াও দিব্য উদাসীন থাকিলে তাহা মানবিক গুণাবলির পরিপন্থী হয়। সমস্যা হইল, সভ্যতার অগ্রগতির সহিত যে সকল সংকট দেখা দিয়াছে, তাহারই অন্যতম আত্মকেন্দ্রিকতা। এক দিকে পুরাতন সামাজিক সংহতি এবং যৌথ জীবনচর্যা ক্রমে বিলীয়মান, ছোট ছোট গৃহকোণে মানুষ নিশিদিন নিজস্ব সুখের সন্ধান করিতেছে অন্য দিকে, সমাজজীবন এবং ব্যক্তিজীবনেও অজস্র সংকট ক্রমবর্ধমান। সুতরাং, আপন হইতে বাহির হইবার দায়-গ্রহণের বোধ ক্রমশই কমিয়া আসিতেছে। সুতরাং, মানবিকতার অবক্ষয় এমনই আকার লইয়াছে, কেহ ইহার বিপরীতে হাঁটিয়া কিছু করিলেই তাহা সংবাদ-পদবাচ্য হয়, জনতা সবিস্ময়ে তাকাইয়া থাকেন। বালির ঘটনা হইতে উঠিয়া আসা দ্বিতীয় প্রশ্নটি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। তাহা জটিল প্রশাসনিক রীতিবিধির প্রশ্ন। দমকল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। পুলিশ বিভাগও তথৈবচ। এই পরিস্থিতিতে ‘পুলিশ কেস’-এর ভয়ে যদি দমকল কাহাকেও সাহায্য করিতে অস্বীকার করে, অন্যদেরও কাজ না করিবার পরামর্শ দেয়, তখন বুঝিতে হইবে সমস্যাটি গভীরে। সাধারণত বিপর্যয় মোকাবিলা বা ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ বলিতে বৃহৎ কোনও বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়াইয়া তাহার সম্মুখীন হইবার কলাকৌশলকে বুঝায়। এই বিষয়টিকে ক্ষুদ্রতর পরিসরেও বিবেচনা করা উচিত। দুর্ঘটনার বশে গভীর নর্দমায় কেহ পড়িয়া গিয়াছেন, তিনি মারাত্মক রূপে আহত, সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করিতেছেন। কী ভাবে তাঁহাকে সাহায্য করা যাইবে, কত দ্রুত তাঁহার প্রয়োজনীয় চিকিৎসাদির বন্দোবস্ত করা যাইবে, তাহাও এক অর্থে বিপর্যয় মোকাবিলারই অঙ্গ। সেই ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইবার প্রক্রিয়া যে এখনও যথাযথ রূপে গড়িয়া উঠে নাই, বালির দুর্ঘটনা তাহারই প্রমাণ। কার্যত, সত্যটি আরও তিক্ত। কারণ, এই ধরনের কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ-এর ভিতর সমন্বয়ের কাজটিও যে মসৃণ নহে, বালির ঘটনা তাহাও দেখাইয়া দেয়। সরকারি বিভাগের কর্মীরাই যদি নিজস্ব কাজের জন্য পুলিশ বিভাগের সহিত যোগাযোগ করিতে বিমুখ হন, তখন সেই আন্তর্বিভাগীয় যোগসূত্রের অভাবটিও প্রকট হইয়া পড়ে। সেই ক্ষেত্রে সাধারণ পথচলতি জনতা যদি পথিমধ্যে বিপন্ন কোনও ব্যক্তিকে সাহায্য করিবার ব্যাপারে ক্রমেই বিমুখ হইয়া পড়েন, তাহাদের দোষ দেওয়া কঠিন। বিগত প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনে এই আন্তর্বিভাগীয় সমন্বয়ের কাজটি বিষম রূপেই ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। রাস্তাঘাটে ‘মানবিক’ হইবার বিষয়ে প্রশাসনিক তরফে কিছু উৎসাহ, অন্তত এক ধরনের সাহায্যপ্রদান জরুরি। |
|
|
|
|
|