|
|
|
|
বিদায় কলকাতা |
কলকাতার দারিদ্র্য সবচেয়ে নাড়া দিয়েছে মেসিকে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কলকাতার মানুষের দারিদ্র্য দেখেই সবচেয়ে নাড়া খেয়েছেন লিওনেল মেসি। শহর ছেড়ে ঢাকা চলে যাচ্ছেন সোমবার সকালেই। তার আগের দিন আর্জেন্তেনীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, “দারিদ্র্যই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এই ব্যাপারে। কলকাতায় রাস্তায় এত গরীব মানুষ ভাবতে পারিনি।”
আপনাকে ঘিরে মাঠে অব্যবস্থা দেখে আপনি বিরক্ত, না উপভোগ করেছেন? মেসির উত্তর, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি অবাক হয়ে গেছি ভোর চারটের সময় আমাকে দেখতে এত লোক এসেছে দেখে। এখানে সব জায়গায় প্রচুর লোক। আমি উপভোগ করেছি, স্টেডিয়ামে আর্জেন্তিনাকে দেখতে এত দর্শক দেখে। এত লোক আর্জেন্তিনার পোশাক পরে খেলা দেখতে আসে!”
কলকাতায় রবিবার তাঁর শেষ প্র্যাক্টিসে ওই ভক্তদের জন্যই তিনি তিনটি বল এনে শট করে পাঠালেন গ্যালারিতে। শহরে পাঁচ দিনে তাঁর সেরা শট। সেরা ডজও দেখালেন এ দিনই। প্র্যাক্টিস করতে যাওয়ার আগে হায়াত রিজেন্সি হোটেলের লাউঞ্জে।
এক দিকের লিফটের ধারে সার দেওয়া পুলিশ। দড়ি ফেলে দাঁড়িয়ে বাড়তি নিরাপত্তারক্ষীরা। সবাই তাকিয়ে রয়েছে, কখন ও দিক থেকে মেসি নামবেন। আগুয়েরো, ইগুয়াইন, মাসচেরানোরা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন টিম বাসে। হঠাৎই উল্টো দিকের লিফট থেকে নেমে, দৌড়তে দৌড়তে বাসে উঠে পড়লেন মেসি। জনতাকে বোকা বানিয়ে। |
|
যুবভারতীতে শেষ দিন। রবিবার মাঠ ছাড়ার সময়। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
শেষ প্র্যাক্টিসে কী হল? যা হল, ভারতীয় ফুটবলে আগে কখনও হয়নি। মা এসেছেন মেয়েকে নিয়ে। স্ত্রী এসেছেন স্বামীকে নিয়ে। কোনও মহিলা গ্যালারি টপকে ঢুকে পড়েছেন। ও দিকে গ্যালারিতে চলছে টেলিভিশনের সরাসরি ধারাবিবরণী। মেসি ফ্রিকিকে গোল করছিলেন, আর হাজার তিনেক লোক হাততালি দিয়ে উঠছিল। মুখে মেসির জয়ধ্বনি। গ্যালারিতে অনেক প্রাক্তন তারকাও উচ্ছ্বসিত মেসির ফ্রিকিক দেখে।
এই ক’দিন ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিলেন মেসি। নীচে নামা বলতে শুধু খেতে যাওয়া। মাঝে ওয়ার্ম আপ করতে নামা। ভিড়ের ভয়ে, ইচ্ছে থাকলেও তিনি যেতে পারেননি মাদার টেরিজার বাড়ি। এ দিন একটি সেমিনার চলছিল হোটেলে। মেসিকে খেতে আসতে দেখে স্যুট-টাই পরা তরুণরা সব ফেলে সিঁড়ির মুখে হাজির। মেসি বিরক্তিতে ফেরার সময় আর প্রধান গেট দিয়ে বেরোননি। বেরিয়ে গেলেন পিছনের দরজা দিয়ে। পেশাদারিত্বের মুখোশ ছেড়ে মেসির মাঝের নরম মানুষটা বেরোল প্র্যাক্টিসে ক্রমাগত জয়ধ্বনি শুনে। বেরোনর মুখে তিনটি বল নিয়ে মারলেন গ্যালারিতে। ঠিক যেখানে সবচেয়ে বেশি ভিড়।
মেসি শহরে থাকতে থাকতেই সল্টলেক স্টেডিয়ামে আবার সেই ভলভো বাসগুলো ঢুকে পড়েছে। সেই গ্যারাজের চার দিকে ঢাকা দেওয়ার কাপড়ও খুলে নেওয়া হয়েছে। প্রধান গেটের অদূরেই দাঁড়িয়েছিল বাসগুলো। এ দিন প্র্যাক্টিস ঘিরেও বিশৃঙ্খলা অব্যাহত ছিল। সাংবাদিকদের প্রথমে আটকে দেওয়া হলেও, অজস্র লোক ঢুকে পড়েছিল গ্যালারিতে। আর্জেন্তিনা প্র্যাক্টিসে নামতেই মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ে অনেকেই। ম্যাচের দিন যেমন উত্তর চব্বিশ পরগনা পুলিশের বড় কর্তাদের পাস-এ প্রচুর সাধারণ লোক ঢুকে পড়েছিল। |
|
নয়নের মণি। প্র্যাক্টিসে মেসিকে আদর সতীর্থদের। ছবি: উৎপল সরকার |
শনিবার মেসির প্র্যাক্টিস দেখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট ভাই মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন। রবিবার ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠ প্রচুর লোক ঢুকে পড়েন মাঠের ভিতরে। দেখা যায় তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসুকে। মাঠের মধ্যে বেঞ্চে বসেছিলেন সুভাষ ভৌমিকও। অথচ পুলিশ আটকে দেয় মেসি ম্যাচের প্রধান সংগঠকদের। মেসি যখন গ্যালারিতে বল পাঠাচ্ছেন, তখন সেখানে ঘিরে ধরে সই সংগ্রহকারীরা। এক জন একটা মূর্তি তুলে দেন। ওখানেই বিশৃঙ্খলা দেখে মেসিরা তাড়াতাড়ি ফিরে যান। আর্জেন্তিনার পরিকল্পনা ছিল, এ দিন নাইজিরিয়া ম্যাচের জন্য কিছু ট্যাকটিক্যাল প্র্যাক্টিস করবে। এত লোক দেখে তাঁরা আর কিছু করেননি। শুক্রবারের প্রথম দলটাকেই রেখে দিয়ে প্র্যাক্টিস করালেন সাবেইয়া। প্র্যাক্টিস দেখতে এসেছিলেন নইমুদ্দিন, ইস্টবেঙ্গলের সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরী, প্রাক্তন কিপার সুদীপ্ত চক্রবতী, অচিন্ত্য বেলেল। বেরোনর সময় নইম বলছিলেন, “মেসির একটা সই নিতে হবে।”
মেসির সই সংগ্রহের জন্য, ছবি তোলার জন্য গত পাঁচ দিন ধরে যা হল, তা অভাবনীয়। বিখ্যাত লোকেরা-সহ অনেক অনুরাগী মেসিদের হোটেলে উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য। লাখ দুই-তিন খরচ হয়ে গিয়েছে থাকার জন্য। লাভ হয়নি। ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল তাঁর মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন শুধু একটা ছবি তোলার জন্য। পটেল কলকাতায় ফুটবলের প্রচুর কর্তাকে অনুরোধ করেন, তাঁর মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। মেসির ছবির জন্য বাড়তি এক দিন থেকে যান। তাতেও লাভ হয়নি।
অজস্র অচেনা কিশোর কিশোরী বরং হাসিমুখে ফিরল এই পাঁচ দিন প্রবল যুদ্ধ করে। যারা মেসির একটা ছবি, একটা সই পেয়ে গিয়েছে। রেখে দিয়েছে সারা জীবনের জন্য। |
|
|
|
|
|