দেবদেবীরা মর্তে আসে, সঙ্গে আসে কে?
শিবের বডিগার্ড এবং প্রলয়নাচের পার্টনার
বেদ-পুরাণে দেব-দেবীরা বরাবর এক থাকেননি, ক্রমশ পালটে গিয়েছেন। শিব বা রুদ্র বা পশুপতিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। প্রায় সব দেবতারই বাহন আছে। শিবের যেমন নন্দী। কিন্তু নন্দী শিবের বাহন হয়েছেন পরে। প্রথমে তিনি ছিলেন এক স্বতন্ত্র দেবতা। পশুপতির পাশাপাশি তাঁরও পুজো হত। এক সময় তিনি হলেন শিবের দুই দ্বাররক্ষীর এক জন, অন্য জন মহাকাল। এই কারণেই অনেক শিবমন্দিরের সামনে নন্দীর মূর্তি থাকে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। তবে সে মূর্তি সচরাচর বৃষ বা ষাঁড়ের। নন্দীকে আমরা ষণ্ডমূর্তিতেই চিনি। অথচ পুরাণে নন্দীর এই রূপটি বিরল। কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে, মহাদেবের এই প্রধান অনুচরটি করালদর্শন, বামন, বিকটাকার, মুণ্ডিতমস্তক, ক্ষুদ্রবাহু, মহাবল। ষণ্ডরাজকে পাওয়া যায় মন্দির-ভাস্কর্যে, অষ্টম শতাব্দী থেকে। কী ভাবে নন্দী এই রূপ প্রাপ্ত হলেন, সে বিষয়ে কোনও স্থির মত নেই।
নন্দীর জন্ম নিয়ে নানা গল্প আছে। কোনও গল্পে তিনি এক মুনির ছেলে, কোথাও বা বিষ্ণুর সন্তান। তবে প্রায় সব কাহিনিতেই তিনি শিবের সহচর। অনেক সময়েই তাঁকে দেখানো হয়েছে শিবের অনুচর ‘গণ’বাহিনীর এক নায়ক হিসেবে, যে ‘গণ’র অধিপতি হলেন গণেশবা গণপতি। গণরা থাকে কৈলাসে, তবে মাঝে মাঝেই তারা শ্মশানে ঘোরে। সাধারণত তারা কারও ক্ষতি করে না, তবে কুপিত হলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, যেমন দক্ষযজ্ঞের সময়। এমন প্রলয় মুহূর্তে নন্দীও ক্ষেপে উঠে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারেন, সেটা ভাবাই যায়। গণদের আসল নায়ক অবশ্য বীরভদ্র, দক্ষযজ্ঞের সময় শিবের মাথার এক গাছি চুল থেকে যাঁর জন্ম, ভদ্রকালী যাঁর পত্নী, যে ভদ্রকালীর জন্মও দক্ষযজ্ঞের সময়, সতীর ক্রোধ থেকে।
একটা গল্প আছে যে, শিব আর পার্বতী এক বার জুয়া খেলছিলেন, নন্দী ছিলেন খেলার আম্পায়ার। কিন্তু নন্দী শিবের ভক্ত, অতএব আম্পায়ার নিরপেক্ষ থাকতে পারলেন না। তাই পার্বতী নন্দীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তাঁকে কেউ পুজো করবে না। তখন আবার নন্দী পার্বতীর পায়ে পড়লেন, পার্বতীর রাগ পড়ল, ইত্যাদি ইত্যাদি।
জগাই বললে যেমন মাধাই, নন্দী বললে তেমনই ভৃঙ্গী। ভৃঙ্গীর জীবনেও অভিশাপের গল্প আছে। ভৃঙ্গীও শিবের অনুচর। নন্দী যেমন হৃষ্টপুষ্ট, ভৃঙ্গী তেমনই সিড়িঙ্গে, কঙ্কালসার। ভৃঙ্গী আগে ছিলেন এক মুনি, শিবের উপাসক। অন্য মুনিরা সবাই শিব এবং পার্বতী, দু’জনের পুজো করতেন, কিন্তু ভৃঙ্গী কেবল শিবের পূজারী, পার্বতীর পুজোয় কিছুতেই রাজি নন। ক্রুদ্ধ পার্বতী অভিশাপ দিলেন। সেই অভিশাপে ভৃঙ্গী কঙ্কালে পরিণত হলেন। দু’পায়ে আর দাঁড়াতে পারেন না তিনি, তখন শিবের আশীর্বাদে তাঁর তৃতীয় চরণের সৃষ্টি হল। কিন্তু তবু ভৃঙ্গী পার্বতীর পুজো করবেন না। তখন শিব তাঁকে নিজের অর্ধনারীশ্বর রূপ দেখালেন, যাতে তিনি বুঝতে পারেন যে পার্বতী শিবেরই অংশ। কিন্তু ভৃঙ্গী ভোলবার নয়। তিনি এক মৌমাছির রূপ ধরে অর্ধনারীশ্বরের পুরুষ-অংশটিতে লুকিয়ে পড়লেন।শিবের নটরাজ মূর্তিতে তাণ্ডব নৃত্যের দৃশ্যে অনেক সময় ভৃঙ্গীকে তাঁর পাশে দেখানো হয় তিনটি পা সমেত।

বর লেনদেন করলেন বিষ্ণুর সঙ্গে
বৈদিক যুগে বিষ্ণু দেবতা হিসাবে খুব বড় কিছু ছিলেন না। তাঁর প্রতিপত্তি বাড়ে পরে। তখন তিনি বাহনও লাভ করেন। সেই বাহনের নাম গরুড়। গরুড় কশ্যপ মুনির সন্তান। কশ্যপের অনেক স্ত্রী ছিলেন। বিনতা তাঁদের অন্যতমা। এই বিনতার দুই পুত্র: গরুড় এবং অরুণ। কশ্যপের আর এক স্ত্রীর নাম কদ্রু। তাঁর অনেক সন্তান, সবাই সাপ। বলে রাখা ভাল, নাগেদের সঙ্গেও বিষ্ণুর একটা সম্পর্ক আছে। নাগকুলে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলেন অনন্তনাগ বা শেষনাগ। বিষ্ণু তাঁর ওপর শয়ন করেন। অনন্তনাগ যখন নিজের দেহটি পাকিয়ে ফেলেন, তখন সময় পিছন দিকে যায়, ব্রহ্মাণ্ডের লয় হয়। তিনি যখন পাক খোলেন, সময় এগিয়ে যায়, ব্রহ্মাণ্ডের আবার সৃষ্টি হয়।
গরুড়ের সঙ্গে সর্পকুলের প্রবল শত্রুতা। তার কারণ, কদ্রু বিনতাকে দাসী করে রেখেছিলেন। বিমাতার দাসত্ব থেকে জননীকে মুক্ত করতে চান গরুড়। সে জন্য অমৃত চাই তাঁর। অমৃত আছে দেবতাদের কাছে। গরুড় দেবলোকে অভিযান করলেন। দেবতাদের যুদ্ধে হারিয়ে অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে গিয়ে দিলেন বিষ্ণুর কাছে। কিন্তু নিজে সেই অমৃত পান করলেন না। এই সংযম ও ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু গরুড়কে বর দিতে চাইলেন। গরুড় অমৃত চাইলেন না, কিন্তু অমরত্ব চাইলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করলেন যে, তিনি বিষ্ণুর রথের উপরে থাকতে চান। বিষ্ণু তাঁর সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। এই কাহিনির আর একটি রূপও আছে। তাতে বলা হয়েছে, বিষ্ণু যেমন গরুড়কে বর চাইতে বললেন, গরুড়ও তেমনই বিষ্ণুকে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে কী বর চান?’ বিষ্ণু তখন গরুড়কে তাঁর বাহন হতে এবং রথের ধ্বজায় অধিষ্ঠিত হতে অনুরোধ করলেন। গরুড় বললেন, ‘তথাস্তু’। পুরাণে বর চাওয়া এবং পাওয়ার অনেক গল্প আছে, কিন্তু বর বিনিময়ের এ গল্প অতি উৎকৃষ্ট। তো, বিষ্ণুর আশীর্বাদে অমর হয়ে অমৃতের ভাণ্ডটি নিয়ে গরুড় আবার ডানা মেললেন, সেটি যথাস্থানে রেখে আসতে হবে। দেবরাজ ইন্দ্র অমৃত কেড়ে নেওয়ার জন্য চড়াও হলেন তাঁর ওপর, হানলেন তাঁর বজ্র। গরুড় তো অমর, কিন্তু দেবরাজের অস্ত্র বলে কথা, তার ওপর দধীচীর সম্মানও রক্ষণীয়, অতএব গরুড় তাঁর দেহের একটি পালক নিক্ষেপ করলেন, অর্থাৎ যুদ্ধে অক্ষত থাকলেন না তিনি। ইন্দ্র তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বন্ধু করে নিলেন। এক হিসেবে তো আবার গরুড় ইন্দ্রের ভাইও বটেন, কারণ ইন্দ্রও কশ্যপের সন্তান! এই সূত্রেই গরুড়ের আর এক নাম উপেন্দ্র। গল্পটা আর বেশি জটিল হয়ে ওঠার আগে ছেড়ে নটে গাছটি মুড়িয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

এল শত নাগিনী, এল পিশাচীরা
দক্ষযজ্ঞে শিবের অপমান এবং সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে সতীর দেহত্যাগ চেনা গল্প। এর পর সতীর পুনর্জন্ম হবে পার্বতী রূপে, তাঁর সঙ্গে আবার মহাদেবের বিবাহ হবে, সে অন্য কাহিনি। সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর শব কাঁধে করে শিবের তাণ্ডবনৃত্য, তার পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে সতীদেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়া, যেখানে পড়ল সেখানে শক্তিপীঠ তৈরি হল এ কাহিনি তো আমরা বহু বার শুনেছি। তবে একটা কথা মনে রাখা ভাল। চারটে শক্তিপীঠ ছিল আদিপীঠ, সেগুলি নিয়ে কোনও তর্ক নেই। ওড়িশায় পুরী এবং তারা তারিণী, অসমে কামাখ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় দক্ষিণা কালিকা পীঠস্থানের যে কোনও তালিকায় এই চার পীঠ আছে। বাকি পীঠগুলি নিয়ে নানা মত।
পার্বতীর অনেক রূপ। দুর্গা, কালী এবং গৌরীরকথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা সাধারণত খেয়াল করি না যে, শক্তি বা পার্বতীর নানা রূপের ভাবগুলি এক রকম নয়। কোনও রূপ মাঙ্গলিক, কোনওটি অমঙ্গলের সূচক, আবার কোনওটি এই বিভাজনের বাইরে নিরপেক্ষ। পার্বতীর নানা রূপের মধ্যে আছেন নবদুর্গা, আছেন দশমহাবিদ্যা।
নন্দী-ভৃঙ্গী যেমন শিবের অনুচর হিসেবে পরিচিত, পার্বতীর সহচরী তেমনই জয়া-বিজয়া। আবার, যোগিনীরাও তাঁর সঙ্গিনী। অমনিতে যে নারী যোগ অভ্যাসে পারঙ্গম, তিনিই যোগিনী। কিন্তু মহাশক্তির সহচরী হিসেবে যোগিনীর অন্য মহিমা। বিশেষত তন্ত্রে যোগিনীরা দৈবশক্তির অধিকারিণী রূপে পূজিত।
যোগিনীর উদ্ভব হল কী ভাবে? অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দুর্গা আপন শরীর থেকে আট জন যোগিনী সৃষ্টি করলেন, প্রত্যেকে আবার আট জনকে সৃষ্টি করলেন, সুতরাং যোগিনীর সংখ্যা হল ৬৪। কোথাও কোথাও আবার ৮১ জন যোগিনীর উল্লেখ আছে। যোগিনীরা ঠিক কোন ভূমিকা পালন করেন, সেটা পরিষ্কার নয়, তবে ৬৪ যোগিনীর চারটি মন্দির পাওয়া গেছে, দুটি ওড়িশায়, দুটি মধ্যপ্রদেশে। কখনও কখনও দুর্গার সঙ্গিনী এবং তাঁর শরীর থেকেই সৃষ্টি হওয়া মাতৃকাদের যোগিনী বলে গণ্য করা হয়।
আর ডাকিনী? তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে ডাকিনী এক স্বতন্ত্র ব্যাপার। কিন্তু হিন্দু ধর্মাচারে ডাকিনী এবং যোগিনী সাধারণত সমার্থক হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের শাঁখিনীও বলা হয়। ডাকিনী মানে যে আকাশপথে চলাচল করে। একটি বৃত্তান্তে ডাকিনী এবং শাঁখিনী ছিল ত্রিপুরেশ্বরের বউ। ত্রিপুরেশ্বর নিহত হওয়ার পরে তারা শিবের কাছে বর পেল যে মানুষ তাদের আরাধনা করবে। তন্ত্রে ডাকিনী যোগিনী শাঁখিনী কামিনী ইত্যাদিদের দেখানো হয়েছে অলৌকিক নারীশক্তি রূপে। তারা মুক্তিলাভের পথে বাধাও দেয়, আবার সাহায্যও করে। ডাকিনী যোগিনী নিয়ে লোকবিশ্বাসে যে ধারণা আছে, তাতে ভয়ও আছে, আবার ভক্তিও আছে। পার্বতী বা দুর্গা কিংবা কালীর পাশে শক্তির এই রূপগুলিও মানুষকে চিরকাল আকর্ষণ করেছে। ভয়ঙ্করের আকর্ষণ চিরকালই প্রবল।
ছবিগুলি এঁকেছেন সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.