|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
চিত্তপ্রসাদ ও প্রতিবাদের চিত্রভাষা |
অরুণ সেন |
চিত্তপ্রসাদ, প্রকাশ দাস সম্পাদিত। গাঙচিল, ৬০০.০০
চিত্তপ্রসাদ: আ রেট্রোস্পেকটিভ, ২ খণ্ড, দিল্লি আর্ট গ্যালারি, মূল্য অনুল্লেখিত। |
গত শতকের চল্লিশের দশকে চট্টগ্রাম থেকে সাম্যবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত দু’জন শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও সোমনাথ হোর’কে কলকাতায় নিয়ে এলেন সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশী। তাঁরা অবশ্য আগেই চট্টগ্রামে, এমনকী মাঝে মাঝে কলকাতায় যাতায়াতে, পার্টির সাংস্কৃতিক কর্মে জড়িয়ে ছিলেন। এ বার যোশীর প্রেরণায় এসে পড়লেন বৃহত্তর জগতে। এরই মধ্যে অগ্রজ চিত্তপ্রসাদ কালি-কলম-তুলির রেখায় এবং পরে কাঠখোদাই আর লিনোখোদাই মাধ্যমে নিজের ছবির একটা ভুবন তৈরি করে ফেলেছেন। তিনি তাঁর ছবি আঁকা শুরুই করেছিলেন ’৪৩-এর মন্বন্তর, কৃষক-আন্দোলন, গ্রাম ও শহরের মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে-- এ ভাবেই প্রগতি ভাবনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন তাঁর শিল্পে। পার্টির নির্দেশে স্থায়ী ভাবে চলে গেলেন মুম্বই এবং সেখানেও নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন শিল্পভাষার প্রসারে।
রাজনীতির গোলমালে এক সময়ে পার্টি থেকে সরেও এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজস্ব শৈলীর ওই শিল্পকে ছাড়েননি। তাঁর আসল জায়গাটা তখনও ছাপাই ছবিতেই। এই সব ছবির কথা অন্তরঙ্গ মহলের বাইরে অল্প লোকেই জানত। আরেকটা কারণ ছিল তাঁর আপসহীন মেজাজ। ছবিকে তিনি পণ্য করতে চাননি কখনও। অথচ তিনি যে কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, তার স্বীকৃতি আছে নন্দলাল থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরই মুখে। পরে বিদেশি বন্ধু ও ভক্তদের তারিফও পেয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না চিত্তপ্রসাদ। মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে একটি ঘরে বসে দৈন্যদশাতেও নিঃসঙ্গ এই শিল্পী নিজের কাজ করে গিয়েছেন। কলকাতার জন্য একটা টান ছিল সব সময়ই। জীবনের একেবারে শেষ পর্বে ফিরেও এসেছিলেন, কিন্তু তখন তো তিনি মৃত্যুর সীমানায়।
এই হলেন চিত্তপ্রসাদ: ব্যক্তিগত ও শিল্পগত দুই পরিচয়েই অনন্য। তাঁকে ওই সমগ্রতায় চিনুক সবাই-- চাইতেন তাঁর বন্ধুরা, তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পানুরাগীরা। এ বার বোধহয় তা-ই সম্ভব হল। কঠোর আদর্শবাদী ও মৌলিকতায় দীপ্র, যদিও অবজ্ঞাত, এই প্রতিভাকে দীর্ঘ পরিসরে চিনিয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’টি অসামান্য উদ্যোগ। প্রথমটি বাংলায় প্রকাশ দাস সম্পাদিত বই চিত্তপ্রসাদ এবং দ্বিতীয়টি দিল্লি আর্ট গ্যালারি আয়োজিত প্রদর্শনীর সূত্রে ইংরেজিতে চিত্তপ্রসাদ/ আ রেট্রোস্পেকটিভ।
একদা রামকিঙ্কর বিষয়ে প্রকাশ দাসের মনোনিবেশ শ্রদ্ধা কুড়িয়েছিল অনেকের। চিত্তপ্রসাদকে চেনানোর কাজটা তার চেয়েও বিশিষ্ট। শিল্পী ও ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অসাধারণত্বের সঙ্গে তাঁর এই অবহেলিত অস্তিত্ব এমন মিশে আছে বলেই হয়তো। বইয়ের শুরুতে তাই যে ভূমিকাটি লিখেছেন প্রকাশ, দিগ্দর্শন হিসেবে তা খুবই জরুরি। চিত্তপ্রসাদের জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ, বাংলার ও ভারতের প্রধান রাজনৈতিক ঘটনাবলি, শিল্পকর্মের বৈচিত্র ও দ্যোতনা সব কিছুরই আলোচনায় তিনি পাঠককে প্রস্তুত করে দেন। আর সেই সঙ্গে এই সংকলনের বিষয়-নির্বাচনে ও লেখক-নির্বাচনে দেখাতে পারেন নির্ভুল মাত্রাজ্ঞান। ব্যক্তি-চিত্তপ্রসাদ ও শিল্পী-চিত্তপ্রসাদকে কখনও পৃথক ভাবে, কখনও সমন্বিত ভাবে নিয়ে আসারই পরিকল্পনা এখানে। তাই লেখকসূচিতে চিত্তপ্রসাদের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু ও সহকর্মীরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন পরবর্তী শিল্পবোদ্ধারাও সময়-সময় তো তাঁরা একই মানুষ। ফলত স্মৃতিচারণ এই বইয়ের একটা বড় পাওনা। হয়তো কারও মনে হবে, মানুষ-চিত্তপ্রসাদ যতটা, তাঁর শিল্পী-পরিচয় ততটা বিস্তারিত নয়। তবু, দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কমলকুমার মজুমদার যেমন চিত্তপ্রসাদের আলো-ছায়ার সংঘাতের ভেতর দিয়ে রূপসৃষ্টির কথা তোলেন, তেমনই যোগেন চৌধুরী বলেন সাদা-কালোর লিনোকাটের কাজে তাঁর ‘রীতিনীতি ও গঠন’-এর স্বকীয়তার কথা।
চিত্তপ্রসাদ/ আ রেট্রোস্পেকটিভ দু’টি খণ্ডে প্রকাশিত। প্রথমটির লেখক সঞ্জয়কুমার মল্লিক এবং দ্বিতীয় খণ্ডেও সম্মিলিত গবেষণার অন্যতম শরিক তিনি। বিশ্বভারতীর কলাভবনের শিল্প-ইতিহাস বিভাগের এই তরুণ সহযোগী-অধ্যাপক শিল্প-বিষয়ক নানামুখী লেখালেখি ছাড়াও চিত্তপ্রসাদকে নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত আছেন অনেক কাল। খুবই প্রশংসনীয় যে, দিল্লি আর্ট গ্যালারি তাঁদের এই চিত্তপ্রসাদ-পরিকল্পনায় কাজে লাগিয়েছেন সঞ্জয়ের ওই গবেষণাকে।
চিত্তপ্রসাদের ছবির বিষয়ের কেন্দ্রীয়তা ও বৈচিত্রের সন্ধান মেলে বাংলা ও ইংরেজি দু’টি বইতেই। ’৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি এঁকে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন জয়নুল আবেদিন, গোবর্ধন আশ, সোমনাথ হোরের পাশে চিত্তপ্রসাদও। অথচ, প্রত্যেকের ছবির ধরন বা প্রকরণ কী গভীর ভাবে আলাদা! সঞ্জয় তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন চিত্তপ্রসাদের রেখায় বা ছাপাই-কাজের বৈশিষ্ট্যে কতই স্বাতন্ত্র্য। তা ছাড়াও অসহযোগ আন্দোলন, তেলেঙ্গানার কৃষক-বিদ্রোহ, বাংলার তেভাগা আন্দোলন, ভারতের নৌ-বিদ্রোহ ইত্যাদি একের পর এক বিষয় আসা-যাওয়া করে তাঁর ছবিতে। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’ ও ‘পিপলস ওয়ার’-এ ছাপা সে-সব ছবি আজও চোখে ভাসে প্রাচীনদের, এবং পুনর্মুদ্রণে এ কালের সংস্কৃতিকর্মীদেরও। মন্বন্তরের ছবির সঙ্গেই কৃষক-জীবন ও তার নিঃসীম দারিদ্র কিংবা কৃষক-সমাবেশ ও প্রতিবাদ। পরে মুম্বইয়ের সুতাকল শ্রমিকদের ধর্মঘট বা রেল-ধর্মঘট।
ইংরেজি বইটির প্রথম খণ্ডের প্রথমাংশে সঞ্জয় চিত্তপ্রসাদের ছবির পটভূমিকে তুলে ধরেছেন চল্লিশের দশকের চিত্তপ্রসাদের উন্মোচনে। দু’টি খণ্ডেই দেখি, স্কেচ পোস্টার কার্টুন ও আরও নানা চেনা মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ ও জনজীবন কী ভাবে রূপ পেয়েছে এমনকী তাঁর হাংরি বেঙ্গল রচনাটিতেও। সঞ্জয়ের ব্যাখ্যানে সেই বইটি পড়াও একটা বড় অভিজ্ঞতা। এর পর দেশকে চেনার অভিযান নানা দিক দিয়ে। সেখানে নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, তাকেই ইংরেজি বইটির দ্বিতীয় খণ্ডে বলা হয়েছে ‘প্রতিবাদের ভাষা’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মুখোমুখি চিত্তপ্রসাদের প্রতিবাদ। কিংবা মানুষের শরীর ও মুখ যা রাজনীতির মানুষ হতে পারে, আবার দৈনন্দিনেরও। কিন্তু, সব কিছুতেই পুনরাবৃত্ত তাঁর আসল জায়গা ছাপাই মাধ্যম। সঞ্জয় যাকে বলেছেন ‘প্রিন্টার্স পার্সোনালিটি’, তার বিবর্তন ও বৈচিত্রও। আগে যা ছিল, তার পাশাপাশি নরনারীর যৌনজীবন, সুখী দাম্পত্য, ফুল বা জীবজন্তু কিছুই বাদ যায় না। এ কি শিল্পীর জীবনের ব্যর্থতাবোধেরই পরিপূরণ?
রাজনীতি, সমাজ ও মানুষের যে অঙ্গাঙ্গিতা চিত্তপ্রসাদের ছবিকে শৈল্পিক আয়তন দিয়েছে, তার সঙ্গে সহমর্মিতা সঞ্জয় ও প্রকাশ উভয়ের ভাবনাতেই। আর সে কারণেই প্রতি পদে দু’জনকেই তুলে ধরতে হয় চল্লিশের দশকের বামপন্থী রাজনীতি ও সংস্কৃতির অনিবার্য ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলি।
এর পাশেই অবশ্য চিত্তপ্রসাদের ছবির অন্য এক ঘর আছে যেখানে বার-বার ফিরে আসে ‘বিশ্বশান্তি’ এই শিরোনাম, লোকজীবন লোকশিল্প বা লোকনৃত্যের অনুষঙ্গ, মা ও শিশুর অন্তরঙ্গতা, পুতুলনাচের পুতুল (শেষজীবনে যে-সৃজনকর্মে তাঁর মন গিয়েছিল)। মা তো বটেই, শিশুও তাঁর ছবিতে ভিড় করে আসে। সে যেমন হতভাগ্য শিশুশ্রমিক হতে পারে ‘রূপকথাহীন দেবদূত’ তেমনই কল্পনায় ভর করে মুক্তিপ্রয়াসী। প্রকাশ এবং সঞ্জয় দু’জনেই চিত্তপ্রসাদের ছবির এই শিশুর বিশ্বকে মেলে ধরতে যে-উৎসাহ দেখান, তা তাঁদের নান্দনিক অবস্থানকেই স্বচ্ছ করে তোলে। চিত্তপ্রসাদের এই শেষোক্ত ছবিগুলির প্রতি যাঁর পক্ষপাত, তিনিই জানেন সেখানেই, প্রকাশের ভাষায়, কী ভাবে ‘জেগে ওঠে এক সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন’, কিংবা সঞ্জয় যেমন বলেন, যে-রূপকথাকে হারিয়ে ফেলেছে শিশু, সেই বর্ণময় রূপকথারই যেন পুনরাবিষ্কার। এ সব ছবিও কখনও কালি-কলমে বা প্যাস্টেলে বা কদাচিৎ চারকোলে এবং অবশ্যই উডকাটে তবে সিংহভাগই লিনোকাটে। তাতেই তো স্ফূর্তি চিত্তপ্রসাদের।
সম্পাদনা ও রচনার কৃতিত্বের কথা আবারও উঠতে পারে উভয় বইয়ের ক্ষেত্রেই। বাংলা বইতে বইয়ের গোড়ায় এবং শেষে চিত্তপ্রসাদের নিজের লেখালেখিকে রাখা হয়েছে সযত্নে তাঁর মৌলিক প্রবন্ধ এবং বিভিন্ন জনকে লেখা তাঁর অজস্র চিঠি। চিঠিতে শিল্পীর আবেগমথিত সাবলীল গদ্য পড়তে পারাটাও এক চমকপ্রদ অনুভব। আর ইংরেজি বইটিতে সংযোজিত হয়েছে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, তাঁর জীবন ও ছবি সংক্রান্ত নথি, আলোকচিত্র, তাঁর লেখা এবং তাঁকে নিয়ে লেখার প্রিন্ট, স্মৃতিচারণ ও কথোপকথন চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর চেক্ বন্ধুর। প্রকাশিত হয়েছে আরও তিনটি পরিপূরক বই, (১) তাঁর নির্বাচিত চিঠির ইংরেজি অনুবাদ; (২) দেশ-বিদেশের কমিউনিস্ট নায়কদের ‘স্কেচবুক’; (৩) হাংরি বেঙ্গল-এর যে একটি মাত্র কপি টিকে আছে ইংরেজ শাসকদের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে, তার অবিকল পুনর্মুদ্রণ।
তবে, মূল বই দুটিরই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে শিল্পীর অজস্র ছবির প্রতিলিপি: স্কেচ ছাপাই পোস্টার গ্রন্থচিত্রণ। সাদাকালো আর রঙিন। আর সবের মধ্যেই জ্বলজ্বল করে লিনোকাটের স্বতন্ত্র স্বনির্ভর সৌন্দর্য। মুদ্রণসৌকর্যে নিখুঁত ইংরেজি বইটিতে সাজসজ্জা, বিন্যাস, বাঁধাই ইত্যাদির যে বিস্ময়কর উৎকর্ষ, তা বাংলা বইতে ততটা নেই বোধহয় প্রকাশনাগত সংস্থানের হেরফেরে থাকা সম্ভবও নয়। এতৎসত্ত্বেও অবশ্য বাংলা বইটিতে রুচির যে স্ফুরণ আছে, তা আড়ালে থাকে না। আর সে কারণে দু’টি বই-ই একসঙ্গে আমাদের শিল্পচর্চার জগতে সম্পদ বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। |
|
|
|
|
|