‘রাজনীতি’ ভুলে পরস্পরের পাশে চরবাসীরা
চার দিকে পদ্মার জল ঘেরাই ছিল চরের জীবন। এখন বাস খাস পদ্মার বুকেই।
মাত্র কয়েক মাস আগেই এই জলঙ্গিতেই মুখোমুখি লড়াই হয়েছিল বিধানসভা ভোটে। তৃণমূলের ইদ্রিস আলি এখানে জোটের প্রার্থী হওয়ার পরে কংগ্রেসের গোজ প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সামসুজ্জোহা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিপিএমের আবদুর রজ্জাকই এই বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটে জিতে যান। রাজনীতির সেই লড়াইয়ের ছাপ তার পরেও বেশ কিছু দিন এই এলাকায় ছিল। কিন্তু পদ্মার জল সংসারের দাওয়ায় উঠে আসার পরে অবস্থাটা পুরোই বদলে গিয়েছে। সিপিএমের আবদুর রাজ্জাক বলেন, “আমার বিধানসভা এলাকায় যে এই ভাবে কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম সব দলের প্রার্থীরা হাতে হাত মিলিয়ে একে অপরকে সাহায্য করছেন, তাতে আমি গর্বিত।” ইদ্রিস আলি বলেন, “সরকারে বসার পর থেকেই আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমরা-ওরার প্রভেদ রাজ্য থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে জলঙ্গির এই প্রত্যন্ত চর এলাকা যে নিদর্শন রাখছে তা আমাদের রাজ্যের মানুষের জন্য সুখকর।” তাঁর কথায়, “কেবল বিপদের সময় নয়, সারা বছরই যেন মানুষ এই ভাবে মিলেমিশে থাকে, এটাই আমাদের আশা।” সামসুজ্জোহার কথায়, “উৎসবের সময় বা বিপদের সময়েই মানুষ রাজনৈতিক ভেদাভেদি ভুলে এই ভাবে হাতে হাত রেখে দাঁড়ান। কিন্তু নির্বাচন এলে আবার হানাহানি শুরু হয়ে যায়। সেটা যাতে না হয় সেটাই আমাদের দেখতে হবে।”
জলঙ্গির ঘোষপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের নতুন চর এলাকায় এখন জলের মধ্যেই বসবাস সব সংসারের। প্রায় ৪৫০টি পরিবারের মাটির দাওয়া খসে পড়েছে জলে। কেউ মাচায় আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ বাড়ি ছেড়ে পাশের কোনও উঁচু জায়গায় চলে গিয়েছেন। সেই টুকু জায়গাতেই উনুন চড়ানো হয়েছে। তাতেই পালা করে রান্না করছেন পরিবারগুলি।
প্রায় দু’সপ্তাহের উপরে এই চরের গ্রামে মানুষের বসবাস জলের মধ্যে হলেও সরকারি তেমন কোনও সাহায্য এখনও মেলেনি। মহকুমাশাসক মনোজ চক্রবর্তীর বক্তব্য, “ওই এলাকায় কিছু পলিথিন দেওয়া হয়েছে। ওই চরের মানুষের কী অবস্থা এবং এ ছাড়া আর কোনও সাহায্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা খোঁজ নিয়ে দেখব।” জলঙ্গি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের নন্দিতা মণ্ডলের কথায়, “আমি দ্রুত খোঁজ নিয়ে দেখছি কী অবস্থা। তারপরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গত বুধবার এলাকায় জলঙ্গির বিডিও শুভেন্দু রায় বেশ কিছু পলিথিন ও খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা তা নিতে অস্বীকার করেন। তাঁদের দাবি, সাড়ে চারশো পরিবারের জন্য ৫০টি পলিথিন ও খাবার দিলে সমস্যা হবে। তারা তা নেননি। জলমগ্ন হওয়ার ৬ দিন পর এলাকায় গিয়েছেন বিডিও। অভিযোগ, তার আগে তিনি কোনও খবর নেননি। তিনি বলেন, “জেলা প্রশাসনকে সব কথা জানিয়েছি।”
এমনিতেই চরের জীবন দুর্বিষহ। তার উপরে পদ্মার জলে সংসার ভেসে যাওয়ায় অকূল পাথারে পড়েছেন নতুন চরের মানুষেরা। গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর শেখ বলেন, “প্রায় দশ দিন হয়ে গেল আমরা জলের তলায়। পঞ্চায়েত কর্তারা একদিন চিঁড়ে ও গুড় দিয়ে গিয়েছে। আর কিছু মেলেনি। এমনকি ওষুধও নেই। পরিবার প্রতি একটি করে পলিথিন পেলেও সমস্যা অনেকটা মিটবে।” কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমনই যে, দ্বিতীয় শ্রেণির সাগিরের জন্য পর্যন্ত সময়ে রান্না করতে পারছেন না তাঁর মা। জ্বরে ভুগছেন সত্তরোর্ধ্ব কাশেম মণ্ডল। তাঁর ঠাঁই হয়েছে বাড়ি ছেড়ে সামান্য উঁচু একটু জমিতে। তার বাইরে কাছাকাছি আর কোনও ডাঙার সন্ধান নেই।
অথচ উৎসবের মরসুম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলছে পরীক্ষা। সোনালি ফসল পাট ঘরে তোলার আর সামান্যই বাকি। ঠিক এই সময়েই পদ্মার জল ঢুকেছে গ্রামে। গ্রামের রাস্তায় চলছে নৌকা। মানুষের সঙ্গে গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে একই চালায়। ঘরে কিছুটা মজুত খাবার থাকলেও তা রান্না করার উপায় নেই। উনুনই তো জলের তলায়। ওই গ্রামের বাসিন্দা ঘোষপাড়ার গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য কংগ্রেসের যাবদুল মণ্ডল বলেন, “গোটা গ্রাম জলের তলায় থাকলেও পঞ্চায়েত প্রধান ছাড়া আর কারও দেখা মেলেনি। প্রশাসনেরও কেউ আসেননি। তবে গ্রামের মানুষই রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরকে সাহায্য করতে শুরু করেছেন।”
গ্রামে নেই পরিবহণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ পরিষেবা। যাতায়াত বলতে নিজেদের তাগিদে তৈরি করা হাঁটা পথ। বর্ষায় নৌকা। কেউ অসুস্থ হলে এই বর্ষায় পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে। গ্রামের মহিলা রিনা বিবির কথায়, “ভোটের মরসুম হলে আমরা অনেকের দেখা পেতাম। ভোটের এখন অনেক দেরি তাই কারও আর দেখা মেলেনি।” রিনা বিবির এখন আশ্রয় একটি দোকানের মাচায়। সেখানেই তিনি নিশিদিন নজর রাখছেন রাস্তার দিকে--যদি ত্রাণের কোনও নৌকা আসে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.