দক্ষিণ কলকাতা
অবহেলার জলাশয়
পদ্মে পাঁক
গেট বন্ধ হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। কেননা কোনও পাহারাদার নেই শহরের অতি পরিচিত শরৎ বসু রোডের পদ্মপুকুর স্কোয়ারের। আয়তনে যথেষ্ট বড়, তবু জমাদার এবং মালি বলতে মাত্র এক জন। পদ্মপুকুর স্কোয়ারের বড় অংশ জুড়ে জলাশয়। সেই জলাশয় পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব পুরসভার। কিন্তু, এই জলাশয় পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে পুরসভার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমানে এই জলাশয় ব্যবহার করছে দু’টি সুইমিং ক্লাব।
পুরসভা সূত্রে খবর, ৭২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় আট বিঘা জায়গা নিয়ে পদ্মপুকুর স্কোয়ার। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুরসভার। অথচ, জলাশয়ের জলে নির্বিবাদে চলছে স্নান, বাসনমাজা, সাবান কাচা। বহু বছর ধরে এই জলাশয়ে দু’টি সুইমিং ক্লাব সমান ভাবে নিজেদের সীমানা নির্দিষ্ট করে সাঁতারের প্রশিক্ষণ দেয়। জলাশয়ের এক দিকে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য-সহ আবর্জনা। জলে পাঁকের গন্ধ। ক্লাব দুটি সম্পর্কে পুরসভার তরফে অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে ন্যূনতম আয় নেই পুরসভার। সাঁতার শেখানোর জন্য জলাশয় যে পরিমাণ পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত সেটাও করে না ওই দু’টি ক্লাব।
স্থানীয় অমলকুমার মিত্র বললেন, “এখানকার বৈশিষ্ট্য দুর্গাপুজো। জলে ভাসমান মণ্ডপ হয়। ফলে পুজো শেষ হলে বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলাশয়। অথচ, জলাশয় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে মোটেও তৎপর নয় পুরসভা। মাস পেরিয়ে গেলেও সে রকম উদ্যোগ দেখা যায় না।” এলাকার মানুষের কাছে গর্ব পদ্মপুকুর স্কোয়ার। তাঁদের অভিযোগ, সেটি খোলা-বন্ধের কেন নির্দিষ্ট সময় থাকবে না? কেন নির্দিষ্ট সময়ে গেটে তালা দেওয়ার জন্য পাহারাদার থাকবেন না? তাতে অবাঞ্ছিত লোকজনের প্রবেশ আটকানো যায়।
এক সময় স্কোয়ারের এক ধারে তৈরি হয়েছিল চিলড্রেন্স পার্ক। কিন্তু আজ কার্যত তার অস্তিত্ব নেই। দু’-একটা ভাঙা খেলার সরঞ্জাম পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এবড়ো খেবড়ো মাটিতে আগাছার জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে জায়গাটি। মলমূত্রের দুর্গন্ধে ভেতরে ঢোকাই দায়। তবুও এর মধ্যে দড়িতে ঝুলছে জামাকাপড়।
এখানকার একমাত্র পুরকর্মীর কথায়: “আমার একার পক্ষে রাত-দিন পদ্মপুকুর স্কোয়ার-এর রক্ষণাবেক্ষণ করা খুব কষ্টকর। কোনও পাহারাদার না থাকায় সমস্ত দায়িত্ব আমার ওপর। বার বার অনুরোধ করলেও লোকজন শুনতে চায় না। বাইরের লোকজন এসে আবর্জনা ফেলে যায় এখানে।”
স্কোয়ারের রেলিংয়ে লন্ড্রির কাচা কাপড় শুকনোর দৃশ্যটা প্রতি দিনের। পদ্মপুকুর রোডের ওপর স্কোয়ারের গা ঘেঁষে ফুটপাথে গজিয়ে উঠেছে কিছু দোকান। গত সাত-আট বছরে বাঁশ আর প্লাস্টিকের নীচে লন্ড্রি, খাবারের দোকান, ছোটখাটো গ্যারাজ বিসদৃশ ভাবে আড়াল করছে এই স্কোয়ারকে।
এ সব অভিযোগের কথা মেনে নিয়ে ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের কৃষ্ণা নন্দী বলেন, “পার্কে কোনও দিনই পাহারাদার ছিল না। কাপড় কাচা, স্নান করা যাতে বন্ধ হয় সে জন্য আমরা মানুষকে বলব। কিন্তু স্থানীয় ক্লাব বা যাঁরা স্কোয়ারে ঘুরতে আসেন তাঁদেরও একটু নজর দিতে হবে। ক্লাবগুলো কোনও টাকাপয়সাও দেয় না পুরসভাকে। জলাশয়ও সে ভাবে পরিষ্কার করে না। চিলড্রেন্স পার্ক সাজানোর চেষ্টা করব।”
পদ্মপুকুর স্কোয়ারের অবহেলার বিষয়ে মেয়র পারিষদ (পার্ক ও উদ্যান) দেবাশিস কুমার বলেন, “জানি, ওটার অবস্থা খুব খারাপ। দুই ক্লাবের প্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা দেখা করেছিলেন। তবে জল দূষণমুক্ত করা যথেষ্ট খরচের। এখনই পুরসভার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে পাহারাদার নিয়োগ করার পরিকল্পনা নেই পুরসভার। ক্লাবগুলিকে বলা হয়েছে, দুপুরে ক্লাব ন্ধ থাকার সময় দরজায় তালা দিয়ে পাহারাদারির ব্যবস্থা করতে। তবে জলাশয়টি সাজানোর জন্য ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা নেওয়া হবে।”
পদ্মপুকুর ইয়ং মেনস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব বরুণ অধিকারী বলেন, “বার্ষিক এক হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার টাকা কর গত বছর আমাদের ক্লাব পুরসভাকে দিয়েছে।” জলাশয়ের অপরিচ্ছন্নতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘‘গত ৩০-৪০ বছরে পদ্মপুকুর স্কোয়ারের জল পুরসভার পক্ষ থেকে দূষণমুক্ত করা হয়নি। একা ক্লাবের পক্ষে এ কাজ করা অসম্ভব। ফলে দূষিত জল থেকে চর্মরোগ ছড়াচ্ছে। এই বিষয়টি এবং পাহারাদার ও উপযুক্ত সংখ্যক মালি নিয়োগের দাবি নিয়ে আমরা দু’টি ক্লাব ও বাসিন্দারা সম্প্রতি মেয়র পারিষদের (উদ্যান) সঙ্গে দেখা করি। দেবাশিসবাবু বিশেষ পদ্ধতিতে জলদূষণ মুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তিনি স্থানীয় ভাবে পাহারাদার নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। যা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।”
ভবানীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সচিব উজ্জ্বল বসু বলেন, “আমাদের ক্লাব এখানে ১৯১৭ সাল থেকে রয়েছে। বর্তমানে তিনশো সদস্য বার্ষিক আড়াইশো টাকা চাঁদায় সাঁতার শেখেন। এই সামান্য অর্থে জলদূষণ রোধের মতো ব্যয়বহুল ব্যবস্থা আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।” তাঁর কথায়: “উপর উপর জল পরিষ্কার করা হলেও তা যথেষ্ট নয়। বাইরে থেকে লোকজন এসে ময়লা ফেলে দিয়ে যায়। বারণ করলেও শোনে না।” উজ্জ্বলবাবুর বক্তব্য, ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করলে ক্লাব দু’টিকে পুরসভার লিখিত অনুমতি দিতে হবে। তবে মেয়র পারিষদ বলেন, “বার্ষিক মাত্র হাজার টাকার বিনিময়ে এত বড় জলাশয় ব্যবহার করছে এক একটি ক্লাব। হাজার দু’য়েক শিক্ষার্থী এর সঙ্গে যুক্ত। সে ক্ষেত্রে জল পরিচ্ছন্নতা ও পাহারার দায় পুরসভার উপর কী ভাবে ছেড়ে দিতে পারে ক্লাবগুলি?”

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.