|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
পাখিদের
এই পাঠশালাতে |
|
শালগাছের ফাঁক দিয়ে গোটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। বাংলোর সামনে ফাঁকা জায়গাটা
জুড়ে মাটিতে নুন মাখানো হয় মাঝে-মাঝেই। হঠাৎ! ভোঁস, ভোঁস শব্দে
হাতের চায়ের কাপ চলকে যায় চমকে। ঘুরে এলেন শৈবাল দাস |
‘ডিড য়্যু ডু ইট’...এক বার নয়, পাখিটা পর পর বলেই চলেছে। ওর ডাকটা ঠিক এ এমনই শোনায়। রেড ওয়াটেল্ড ল্যাপিং। আমাদের বাংলার অতি পরিচিত হট্টিটি পাখি। পাখির দেশই বটে এটা। অনাঘ্রাত এ সবুজ বনে নানান পাখির হট্টমেলা। ঘন সবুজে যেমন চোখ জুড়ায়, তেমন মন জুড়ায় রাঙিন পাখিদের ডাকাডাকি আর বর্ণময় ওড়াউড়ির
ফ্যাশন শোয়ে।
২০১১ আন্তর্জাতিক অরণ্য বৎসর। কুলডিহা অরণ্যে পা পড়তেই তাই মনে মনে বলে উঠলাম ‘জয় হো’।
চার ধারে গভীর করে কাটা পরিখার উপর শাল-সেগুনের পাটাতনের সাঁকো পেরিয়ে গাড়িটা যখন ফরেস্ট রেস্ট হাউসের ছাতায় এসে স্টার্ট বন্ধ করল তখন একরাশ তৃপ্তির নির্জনতা গ্রাস করে নিল সমস্ত বন। জঙ্গলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জলপাই সবুজ তাঁবুর সমারোহের মাঝে দু’কামরার স্যুইটের প্রশস্ত বাংলো একটু আলাদা। গহন অরণ্যে, অনন্য এ কুঞ্জ টেনে নিল সব মন।
|
|
গাড়ির ট্যাঙ্কারে পেট্রল ভরে নিয়েছিলাম আগেই। নীলগিরি কাছারি বাজার থেকে দু’রাতের জন্য চাল, ডাল, আটা সবজি অর্থাৎ পেটের পেট্রল মজুত করে অদূরবর্তী ডি এফ ও অফিস থেকে থাকা-সহ অন্যান্য দক্ষিণা দিয়ে কাগজপত্র হাতে পেতে একটু সময় লাগল। সুন্দর কিচেন আছে সেখানে, রসদ নিতেই হবে। রান্না নিজে রাঁধুন বা চৌকিদার রেঁধে দিক, পানীয় জলটা সঙ্গে নিলেই একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
ওড়িশার বালাসোর স্টেশন থেকে মাত্র চল্লিশ কিমি পথ পেরিয়ে পরিচিত পঞ্চলিঙ্গেশ্বরকে বাঁয়ে রেখে সজনাগড় এসেই শুনেছিলাম রোমাঞ্চকর এই তথ্য যে সারা কুলডিহা রেঞ্জ জুড়ে চলছে পাখি গণনা। সারা ভারত জুড়ে যখন চলছে জনগণনা তখন এখানে তার সঙ্গে পক্ষী-গণনা, শুনে বেশ লাগছিল। ১২৬ প্রজাতির পাখির গণনা এখনও পর্যন্ত হয়েছে। পাখিদের ঠিকানা তো একটাই, আকাশ। তারা নীড় বদলায় অজস্র অরণ্যে, তা হলে গণনা চলে কী ভাবে? কলকাতার এত কাছে এই জঙ্গলে হাতির দাপাদাপি আর গাইডের গা-জোয়ারির অনেক গল্প শুনে ভাবছিলাম কখন পাব তাদের দেখা! তবেই তো ব্যাগ গুছিয়ে এখানে আসা সার্থক হবে।
শেষ দুপুরে পুণ্য ঠাকুরের তৈরি গরম মাছ-ভাতে পেট ভর্তি হতে হতেই দেখলাম একপাল মুরগির বাচ্চা তার সবল মার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ কেন যে বলা হল এই জঙ্গলে মুরগি খাওয়া বারণ, বুঝলাম না। চুলোয় যাক মুরগি, আকাশে যে সূর্যটা ক্রমশ হেলে পড়ছে খেয়াল আছে? |
|
রুশিয়া ড্যামে সূর্যাস্ত না দেখলে এ অরণ্যে আসাই বৃথা। চল পান্সি দুড়দাড়িয়ে। প্রায় তেরো কিমি গহন কাঁচা পথে গাড়ি নেচে, গড়িয়ে এসে থামে লোহার ফটকের কাছে, প্রহরী দরজা খুলে দেয়। জঙ্গল লাগোয়া বাফার জোনে সাঁওতাল, মুন্ডা-সহ উপজাতি আদিবাসীদের ছোট গ্রাম, কুটির আর তাদের দারিদ্রের সীমা পেরিয়ে গাড়ি থামে বাঁধের কিনারে। হেঁটে বাঁধের উপর উঠতেই এক দুরন্ত পটভূমি। নীচের গভীর জল বহু দূরে যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে, তাকে বাধা দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে পাহাড়-প্রাচীর। অরণ্যর সঙ্গে হাতে-হাত ধরে পাহাড়-সারি ঢেউ খেলিয়ে কুলডিহা রেঞ্জ ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে সিমলিপালের দিকে।
মাছমারার দল ডোঙা নিয়ে ফিরে আসছে ঘাটে, সূর্যটা লাল-কমলা আবির মেখে তখন পাটে। রং তার চুঁইয়ে পড়ছে ঘন হয়ে গভীর জলে। জলজ আর বনজ গন্ধের ককটেলে ঘোর নোনা তখন ‘খুশির’ মনে, আদিবাসী শিশুদের সঙ্গে অতি ধীর পায়ে ফিরে আসছে শরীর। মন যে রয়ে গেল রুশদের তৈরি রুশিয়া ড্যামের উপর, রুশিয়া গ্রামের ভিতর।
ঘন জঙ্গলে গাড়ির হেডলাইটে রাতচরা বা নাইটজার পাখির জ্বলন্ত চোখ দেখে ফিরতি পথে বুঝলাম অন্ধকার হয়েছে এ বার। পথে হাতিফুলিয়া নালার (বর্ষায় নদী) সামনে এসে ড্রাইভার নিয়মমাফিক গাড়ি থামিয়ে দিল যাদের জন্য, দূরে তাদের নড়াচড়ার শব্দ। এখানে যে নিত্য জড়ো হয় দামালের দল, জল খেতে।
|
|
ফরেস্ট রেস্ট হাউসের সোলার আলোগুলো দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল আর কাছে আসতেই কিচেনের টুংটাং কাপ-ডিশের শব্দে গলাটা যে শুকিয়ে কাঠ বোঝা গেল।
শালগাছের ফাঁক দিয়ে গোটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। বাংলোর সামনে ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে মাটিতে নুন মাখানো হয় মাঝে-মাঝেই। হঠাৎ! ভোঁস, ভোঁস শব্দে হাতের চায়ের কাপ চলকে যায় চমকে। দু’দুটো প্রকাণ্ড বাইসন বা ইন্ডিয়ান গাউর জড়ো হয়েছে। জিভের স্বাদ বদলাবার জন্য। নুন চাটছিল তারা। চৌকিদার সার্চ লাইট মেরে ছবি স্পষ্ট করতেই জঙ্গলে ঢুকে গেল সুঠাম শরীরগুলো নিমেষে। বাংলোর সামনে ওয়াচ-টাওয়ারটা দারুণ। তবুও চেয়ার নিয়ে পরিখার সামনে বসে চাঁদের রোশনাইয়ে বনজ রাতের গভীরতা মাপা উফ্ ভাবা যায় না। গোটা একটা পূর্ণিমাকে সঙ্গী করে এ জঙ্গলে আসা ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার। নিশা অরণ্যে দুধেল আলোয় সবুজ তখন আরও নেশা চাগিয়ে দেয়।
এ অরণ্যে তৃণভোজী অনেক প্রাণী ছাড়াও লেপার্ড আছে। ২৭৩ বর্গ কিমি জুড়ে শাল, সাইকাস, অর্জুন, মহানিমের সঙ্গে আম কাঁঠালের সমারোহ এখানে। গ্রীষ্মে ফল পাকার সময় হাতি, ভল্লুকের বেজায় ফূর্তি। |
|
ট্যাঁ, ট্যাঁ, ট্যাঁ। এখানে একটা ময়ূর আছে। নিঃশব্দে প্রবেশ করে প্রতি ভোরে, ঘুম ভাঙায় সশব্দে। বাংলোর চৌবাচ্চায় জল খেয়ে নাচ দেখায়। আস্তে আস্তে সামনে জড়ো হতে থাকে তখন চিতল আর চৌশিঙার দল, শম্বরও থাকে এদের মাঝে। চলে রূপের দেখনদারি। নুনিয়া চাখতে জড়ো হয় সব। এটা ওদের জলখাবারের আগের মুহূর্ত। আমরাও জলখাবার খেয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিই ১৪ কিমি বনপথ ধরে জোড়াচুঁয়ার পথে।
মাঝরাস্তায় গড়শিমুলিয়াতে নদীর ধারে বিরাট সাইনবোর্ড চোখে পড়বেই, ‘সাবধান! হাতির করিডর’। নদীতে স্নান করে তারা এখানে। জঙ্গলপথে নেমে হেঁটে যেতেই টাটকা ‘পরিজ’। হাতির বিষ্ঠা। নদীর জলে শুঁড় ডুবিয়ে আছে নাকি? |
|
নাহ্। ভোরে স্নান সেরে ফিরে গিয়েছে মহাকালের দল, এখনও জল ঘোলা। অর্জুন গাছের মাথায় বিশাল ‘ঢোলিওমুসা’ বা জায়ান্ট স্কুইরাল এমন লাফালাফি করছে যেন অচেনা অতিথিদের দেখে আহ্লাদে আটখানা। জোড়াচুঁয়ার বাংলোটা আরও নিবিড় অরণ্যের মাঝে। আরও শান্ত। থাকার ব্যবস্থা খারাপ নয়। হঠাৎ ওয়াকিটকিতে খবর আসে কুলডিহা থেকে যারা পৌঁছেছেন পাঠিয়ে দিন এক্ষুনি, প্রায় পনেরোটা হাতির পাল জড়ো হয়েছে এখানে। পড়িমড়ি করে উল্টোপথে আবার দে ছুট। একটু বোধহয় দেরি হয়ে গেল। দেদার নুন খেয়ে অরণ্য গভীরে ঢুকে পড়েছে তারা। আমরা আসার কয়েক মিনিট আগেই। কলমাচাতালে রাতে সাফারি সেরে ফিরে আসার সময় প্রত্যেকের মন খারাপ হয়ে যাবেই। ইস্, ফিরে যেতে হবে এই সুন্দর জায়গা ছেড়ে। আসলে প্রত্যেকটা যাওয়া তো ফেরবারই প্রতিশ্রুতি।
ফিরতি পথে টেন্ডা চেকপোস্টে গাড়ি দাঁড় করাতেই হবে। জঙ্গলের নিয়ম ভঙ্গ করে ফিরছি না তো বা অরণ্যের কোনও সম্পদ নিয়ে? মুচলেকা দিতেই হবে রক্ষীর কাছে। সামনের সজনে গাছের ডালে সুরেলা বেনেবউটা বলেই চলেছে, ‘গেরস্তের খোকা হোক...’।
|
কী ভাবে যাবেন |
কলকাতা থেকে ট্রেনে বালাসোর। এখান থেকে দু-তিন
দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে কুলডিহা অরণ্য। |
|
কোথায় থাকবেন |
কলকাতা থেকেই বন দফতরের অতিথি নিবাস বুক করে নিতে পারেন। |
|
কখন যাবেন |
কুলডিহা অরণ্যে যাবার সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর বন্ধ থাকে। |
সঙ্গে রাখবেন |
মশা প্রতিরোধী ক্রিম। |
|
|
|
|
|
|
|