গোল না পেলেও জাদু ছড়ালেন বিড়ম্বনার মাঠে
বিশৃঙ্খলার মহামঞ্চেও শিল্পের মঙ্গলকাব্য লিখে গেলেন মেসি
আর্জেন্তিনা-১ (ওতামেন্দি)
ভেনেজুয়েলা-০
বিশ্ব ফুটবলের কোন তিন জন স্টপারকে আপনি সবচেয়ে ভয় পান? লিওনেল মেসি এ বার থেকে কখনও মজা করে বলতে পারেন, “পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ! পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ! পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ!”
মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময়, পুলিশের থিকথিকে ভিড়ে প্রায় পদপিষ্ট তিনি। একটা সময় অসংখ্য উর্দির মাঝে দেখা যাচ্ছিল শুধু বিহ্বল মুখ!
স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, সেই বিহ্বলতার সঙ্গে আতঙ্কও লেগে চোখেমুখে। কিছুক্ষণ আগে লোডশেডিংয়ে আড়াই মিনিট অন্ধকারে কাটিয়েছেন ড্রেসিংরুমে। বেরনোর সময়েও ঠেলাঠেলি। পুলিশ এবং জনতা, কে মেসির ভার নেবে? ছবি তুলবে? মৃদু লাঠি চার্জও হল।
এই দু’টোর মাঝখানের দৃশ্যটা আবার হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া। ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছে আধ ঘণ্টা। গ্যালারি টপকে শূন্য মাঠে ঢুকে কেউ ছুঁয়ে দেখছিলেন ঘাস। শুয়ে পড়ছিলেন। পোস্ট ধরে ঝুলছিলেন। এই ঘাস ছুঁয়েছে মেসির পা? এই পোস্টে ছুঁয়েছে মেসির বাড়ানো পাসে দি’মারিয়ার শট?
কলকাতায় স্বপ্নের মেসির ম্যাচটারও তিন অধ্যায়। বিশৃঙ্খলা, অপার সৌন্দর্য এবং বিশৃঙ্খলা।
তখন তিনিই শীর্ষে। ছবি: দেবাশিস রায়
ঠিক এক সপ্তাহ আগের শুক্রবার মোনাকোয় মেসিকে আটকানোর দায়িত্বে ছিলেন নিকোলাস ওতামেন্দি। সুপার কাপে পোর্তো-বার্সেলোনা ম্যাচটায়। ওতামেন্দির ট্যাকলে কত বার মার খেয়েছেন মেসি!এক সপ্তাহ পরের শুক্রবারের কলকাতা। সেই মেসির কর্নার থেকে হেডে গোল ওতামেন্দির। স্বপ্নের ম্যাচের স্মারক থাকল কলকাতার।বার্সেলোনার মেসি বনাম আর্জেন্তিনার মেসি এই তর্কটা এখন বিশ্ব ফুটবলের সেরা গবেষণা। কলকাতা সেই গবেষণাটা জাগিয়ে রেখে দিল। ইনিয়েস্তা, জাভি, দাভিদ ভিয়ার জন্য একটা এসএমএস পাঠাতে পারেন মেসি। “দেখলে তো, তোমরা না থাকায় গোল পেলাম না।” ইদানীং বার্সেলোনা ম্যাচ হলে মেসির গোল অবধারিত। কত রকম বর্ণময় গোল, কলকাতা দেখেছে টিভির পর্দায়।সামনাসামনি সেই গোল দেখা হল না কলকাতার। আগের দিনের সেই হাফ ভলি, ব্যাকভলির গোলও তো দেখা গেল না।বদলে কী দেখল? দু’তিন জনের পাশ দিয়ে ড্রিবলিংয়ে অনায়াস বেরিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ নিয়ে ফেলছেন গতি। গতির উপরেই জ্যামিতিক সেন্টার। একটা পাস নিয়ে তৃতীয় পাসের কথা ভেবে ফাঁকা জায়গায় চলে যাচ্ছেন। যুবভারতী দেখল মেসির মঙ্গলকাব্য। স্কিলের এই বিচ্ছুরণ, বিস্ফোরণ কোনও দিন দেখেনি কলকাতা।
বার্সেলোনায় মেসির রঙিন সাফল্য কেন আর্জেন্তিনার হয়ে দেখা হয় না, তার প্রধান ব্যাখ্যা একটাই। নীল-সাদা জার্সিতে জাভি, ইনিয়েস্তার মতো বুদ্ধিদীপ্ত পাসার নেই। শুক্রবার দেখা গেল, ভেনেজুয়েলার শারীরিক ফুটবল ও প্রতি আক্রমণ সামলাতে আর্জেন্তিনার কোনও ভাল স্ট্রাইকারও নেই। রিয়াল মাদ্রিদের দুই তারকা ইগুয়াইন বা মারিয়া এখনও বার্সার ভিয়া বা পেদ্রো নন। আর্জেন্তিনায় রিয়াল-বার্সা বোঝাপড়া জমছে না। পাসিং প্রখর নয়। রক্ষণে মারাদোনার আমলের অসুখ দূর হয়নি। দু’দিক দিয়ে বার্সার স্টাইলে সাইডব্যাকদের ওভারল্যাপও নেই।
সাবেইয়া কোচ হওয়ার পরে মেসির জন্য জায়গাটা বরাদ্দ করেছেন মূলত ডান দিকে। মারাদোনার সময় এতটা ডান দিকে দাঁড়াতেন না মেসি। তখন অনেক বার পাল্টাতেন জায়গা। এ দিনও অনেক বার নীচে নামলেন জায়গা তৈরি করতে। দু’বার গোলও হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ভেনেজুয়েলা চমৎকার সাজিয়ে ছিল রক্ষণ। তাতেও মেসির ঝলসানো স্কিল গ্যালারিকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল বার্সেলোনার দেশে। যাকে বলা হয়, ভিন গ্রহের ফুটবল।
এবং মেসির জন্যই আলেসান্দ্রো সাবেইয়া বলতে পারলেন, “দশে নিজেদের ছয় দেব।” অভিনেতা, গায়ক, ফুটবলার কলকাতার মানুষ যাঁদের জন্য আদেখলাপনা দেখান, সেই নায়করাও হয়ে গেছিলেন নিছক ভক্ত। বুয়েনস আইরেস থেকে এই ম্যাচটা দেখতে এসেছিলেন ফেদেরিকো আর তিন সঙ্গী তরুণ-তরুণী। মেসি তাঁদের প্রাণ ভরে দিয়ে গেলেন স্কিলের ঐশ্বর্যে। বার্সেলোনার সমর্থক রাতারাতি অনেক বাড়তে বাধ্য কলকাতায়।
যুবভারতীর এই কৃত্রিম ঘাস ফুটবলারদের মারাত্মক শত্রু। দৌড়লে টান ধরে পেশিতে। ঘাসের নীচের গরমে পাগল করা অবস্থা। ম্যাচ থামিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে এক বার মেসিদের মাথায় জল ঢালতে হল। বিরতিতেই রেফারিকে মেসি অনুরোধ করেছিলেন, এত গরমে টানা খেলা যাবে না। এক মিনিট সময় দিন, জল খাওয়ার জন্য। সেই অনুরোধের কথা জানতে পেরে তাতে সাড়া দেন ভেনেজুয়েলার কোচও। সে অনুরোধ রেখেছেন রেফারি। এই ঘাসে জল না দিলে আরও মুশকিল। দু’শো পুলিশ মাঠে ঢুকে থাকলেও ম্যাচের আগে জল দেওয়ার কর্মীদের ঢুকতে দেয়নি তারা! ভুল শুধরনো হল বিরতিতে। গ্যালারির আনাচে কানাচে এ দিন ভারতীয় তারকা ফুটবলাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিলেন। অনেকেই বলছিলেন, “মেসিকে দেখার পরে বুঝতে পারবে আমাদের সমস্যাটা কী?”
ঘাস আসল খেলাটা খেলতে দিল না। আর একটা পাথর হয়ে দাঁড়াল ভারতীয় বল। আদিদাস বা নাইকি বলে খেলা অভ্যাস, সেখানে নিভিয়া বলে সুইং বুঝতে সমস্যা। ময়দানের জাদুকর সামাদের সেই গল্পের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তাঁর ফ্রি কিক গোলের উপর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, গোল পোস্টটা মেপে দেখতে! মেসিও বলতে পারতেন, বল আর মাঠটা ঠিক হলে একটা ফ্রি কিক গোল দেখতে পারত কলকাতা! আর্জেন্তিনা কোচ সাবেইয়া বলে গেলেন, বেকহ্যামের থেকেও মেসি ফ্রি কিকে এগিয়ে। খারাপ বলেননি।
এমনিতে সাবেইয়া প্রথম ম্যাচই বিতর্ক তৈরির লোক নন। বিলার্দো বা মেনোত্তির মতো খ্যাপাটে নন। সাংবাদিকদের সামনে এসে তিনি বললেন, “ঘাস বা বল কোনও সমস্যা নয়।” কিন্তু মনে হল, এ সব আড়াল করার জন্যই বলা।
শুধু মাঠ আর বল কেন, মেসি পুজোর জন্য উপকরণ কী ছিল কলকাতার?
কেন, সেই বিশৃঙ্খলা!
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ যে ভাবে সংগঠিত হয়, সে ভাবে আর্জেন্তিনার আন্তর্জাতিক ম্যাচ করতে গেলে কী কী সমস্যা হতে পারে? সেই সমস্যাতেই আক্রান্ত ছিল তিন অধ্যায়ের মেসি ম্যাচ।
দুপুর দুটো। মেসিরা নামতে তখনও পাঁচ ঘণ্টা বাকি। তখনই লোক ঢুকে পড়েছে গ্যালারিতে! মাঠের ভিতরে মেসিদের রিজার্ভ বেঞ্চে চলে যাওয়া যাচ্ছে। চলে যাওয়া যাচ্ছে আর্জেন্তিনা ড্রেসিংরুমের সামনে। বাইরে তখন কার পার্কিংয়ের জায়গায় কাদা সামলাতে বালি ফেলা হচ্ছে। ঘাস ছাঁটাই হচ্ছে। পুলিশের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পে ডিউটি বণ্টন হচ্ছে মাইকে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে এমনই হয়। সব শেষ মুহূর্তে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচে তো এক দিন আগে মাঠের দায়িত্ব নিয়ে নেয় পুলিশ। গ্যালারিতে খাবার স্টল নেই। অনেক জায়গায় টয়লেট নেই। জল নেই। সব নেই রাজ্যের বাসিন্দা!
নিরাপত্তা চুলোয় যাক, আগে তো ছবি তুলি! মেসিকে ঘিরে বিশৃঙ্খলায় এ ভাবে সামিল রক্ষীরাও।
ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা তিনেক আগে আর্জেন্তিনা তাদের জিনিসপত্র মাঠে পাঠানোর চেষ্টা করছিল। হোটেলের লবিতে অপেক্ষায়। কিন্তু নিয়ে যাওয়ার লোক নেই! স্টেডিয়ামে তখন কে কী করবে, কেউ জানে না! টিম লিস্টটা পর্যন্ত এল ৪৫ মিনিট আগে! মাঠ ভর্তি তখন দু’শো পুলিশ। এত পুলিশ কী করবে মাঠে? বোঝা গেল শেষ দিকে। ছেলে-বউয়ের জন্য মোবাইল ক্যামেরায় মেসির ছবি তুলে নিয়ে গেল তারা! মেসিকে মারাত্মক ভয় পাইয়ে দিয়ে। ও দিকে তখন ভিভিআইপি গ্যালারিতে বসে রাহুল বোস, শান, ভাইচুং, রেনেডি সিংহের মতো ভিআইপি-রা। ম্যাচ শেষে বাইরে বেরোতে গিয়ে ভিড়ের চাপে তাঁদের নাজেহাল দশা। সেখানে কোনও নিরাপত্তারক্ষীই তখন নেই। সকলেই মেসি-দর্শনে ব্যস্ত! তার পরে তো অব্যবস্থার শেষ চিত্রকথা ড্রেসিংরুমে লোডশেডিং!
শান্ত মেসি আসলে কী অনিঃশেষ জাদু, ধারণা নিয়ে গেল কলকাতার জনতা।
বিরক্ত, হতবাক মেসি কলকাতা থেকে কী ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন? ও সব কথা আজ থাক বরং!

ছবি: উৎপল সরকার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.