|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ২... |
|
বালিকার বাহাদুরি |
বাঙালি ড্রয়িংরুমকে বুঁদ করে রেখেছে ছয় থেকে এগারো বছরের কন্যারা। টেলিভিশনের পর্দায়
বাচ্চাদের টিআরপি-ই এখন সব চেয়ে চড়া। কেন? খোঁজ করলেন সংযুক্তা বসু |
দৃষ্টান্ত ১: টিআরপি ১১ থেকে ১৩-র মধ্যে। জনপ্রিয়তার নিরিখে সর্বোচ্চ। বছর তিনেক হতে চলল, চলছে। সিরিয়ালের নায়িকার নাম ঝিলিক। বয়স ১০। দৃষ্টান্ত ২: বাড়ির কর্তা দেখতে চান অণ্ণা হজারে থেকে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কী করছেন কী করছেন না। আর কাজের মেয়ের পছন্দ সিরিয়াল। বৈঠকখানা ঘরে একটা মাত্র টিভি নিয়ে ধুন্ধমার কাণ্ড। সিরিয়ালের নায়িকার নাম তানি। বয়স ১১। দৃষ্টান্ত ৩: ফুটফুটে ছোট্ট একটা মেয়ে। কী দারুণ অভিনয় করছে। কী মিষ্টি, কী মিষ্টি, বলছেন দর্শকেরা। সিরিয়ালের নায়িকার নাম পূর্ণা। বয়স ৬।
প্রথম সিরিয়ালের নাম ‘মা’। দ্বিতীয় সিরিয়ালের নাম ‘কন্যা’। সদ্য শেষ হয়েছে। তৃতীয় সিরিয়ালের নাম ‘দুয়োরানি’। তিনটে ভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শিত সিরিয়ালের মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল একটা জায়গাতেই। প্রত্যেকটা গল্পেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকছে অল্প বয়েসি মেয়ে। মানে বালিকা বলা হয় যাদের। ‘মা’-এর জনপ্রিয়তা এতটাই যে অচিরেই হিন্দিতেও এই সিরিয়াল দেখা যাবে। একই প্রযোজক, ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারেই।
কোন ম্যাজিকে বালিকাদের নিয়ে গল্প বলা সিরিয়ালে আটকে যাচ্ছে দর্শকের চোখ? কেনই বা এই সব সিরিয়াল দেখার জন্য মুখিয়ে বসে থাকছে বাড়ির বৌ থেকে কাজের মেয়ে থেকে ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষেরাও? উত্তরে বেহালার গৃহবধূ রুবি গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “বাচ্চা মেয়েদের অভিনয় দেখতে খুব ভাল লাগে। কত দরদ দিয়ে চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলে ওরা। দেখে হাঁ হয়ে যাই। আরেকটা কারণ, মেয়েরা আজকাল পুরুষদের সমান সমান। তাদের জ্বালাযন্ত্রণা নিয়ে সিরিয়াল হলে তো দেখতেই হয়।”
অন্য দিকে হাওড়ার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সুবীর ঘোষ ‘মা’ সিরিয়ালটি দেখার জন্য অফিস থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ি গিয়ে টিভির সামনে বসেন। নেশা এমনই চেপে বসেছে সুবীরবাবুর মনে যে, পাড়ায় গিয়ে সান্ধ্য আড্ডাটাও বন্ধ। তাঁর কথায়, “‘মা’ গল্পে যেমন ঝিলিক বলে মেয়েটা চুরি হয়ে যায় এবং চোর-পকেটমারের দলে গিয়ে পড়ে, ঠিক সে ভাবে খবরের কাগজে চোখ রাখলে দেখবেন মেয়ে পাচারচক্র কী সাঙ্ঘাতিক ভাবে কাজ করছে। সিরিয়ালটা খুব বাস্তব মনে হয় বলেই প্রত্যেক দিন উৎকণ্ঠা নিয়ে দেখি।”
হঠাৎ এই সব বাচ্চা নায়িকাদের অভিনয় করিয়ে সিরিয়াল হিট করানোর ফর্মুলাটা তৈরি হল কী ভাবে? ‘মা’-এর প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের মহেন্দ্র সোনি বললেন, “ফর্মুলাটা হল আসলে সারল্য। সিম্পলিসিটি। সিরিয়ালে যে ধরনের জটিল গল্প বলা হয় তা থেকে বেরোতে প্রেম, পরকীয়া, দাম্পত্যের যুদ্ধ, এ সব বাদ দিয়ে খোঁজ চলেছিল। ‘মা’ আসলে এক জন মা আর তার মেয়ের গল্প। এই গল্পের সারল্য, স্নেহ, মায়া, মমতাবোধই সিরিয়ালটিকে হিট করিয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকেও ঝিলিকের লড়াই দেখে মানুষ কৌতূহলী হয়েছে। পুরো গল্পটাতেই একটা সহজ সরল পজিটিভ সুর আছে।”
আসলে বাচ্চা মেয়েদের দুঃখকষ্টকে মুখ্য চরিত্র করে গল্প বলার ঝোঁক টেলিভিশনে প্রথম শুরু হয় মুম্বইতে। ২০০৮ সালে। যখন ‘বালিকা বধূ’ আর ‘উত্তরণ’ নামে দু’টি হিন্দি সিরিয়ালের টিআরপি গ্রাফ চড়তে থাকে। সিরিয়াল হিট করানোর রোল মডেল হয়ে ওঠে ‘বালিকা বধূ’র ছোট্ট মেয়ে আনন্দী, আর ‘উত্তরণ’-এর ইচ্ছা। এর পরেই ২০০৯-এ বাংলায় ‘মা’ সিরিয়ালের আবির্ভাব। ইচ্ছা বা আনন্দীর পথ ধরেই কি চলে এল ‘মা’, ‘কন্যা’ আর ‘দুয়োরানি’? ‘দুয়োরানি’ সিরিয়ালের প্রদর্শক মহুয়া বাংলার আধিকারিক, সেই যুবরাজ ভট্টাচার্য জানালেন, “বাচ্চা মেয়েদের পর্দায় দেখতে খুব মিষ্টি লাগে। দর্শকেরা তাদের ভালবাসতে শুরু করে, তাড়াতাড়ি আপন করে নেয়। তাতে টিআরপি বাড়ে। সেই জন্যই মেয়েদের নিয়ে গল্প বলার এই ঝোঁকটা এসেছে। তবে ‘মা’ বা ‘দুয়োরানি’ কোনওটাই কোনও হিন্দি সিরিয়ালের আদলে তৈরি হয়নি।”
কন্যাসন্তান জন্মানো যে দেশে অভিশাপ, সেখানে অল্প বয়েসি মেয়েদের প্রতি এত টান তৈরি হওয়ার কারণটা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করলেন কর্পোরেট হাউসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা কমীর্। বললেন, “করুণরসের জয় আসলে। মেয়েরা দুঃখ-বেদনা পেলে জয়ের সম্ভাবনা আরও বাড়ে। এই সব সিরিয়ালে বাচ্চা মেয়েদের ওপর যে ধরনের নির্যাতন হচ্ছে, তা দেখতে দেখতে দর্শক নিজেদের জীবনটাকেই দেখতে পাচ্ছে যেন। আরও সহজ করে বলতে গেলে, ঠিক যে ভাবে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের দুঃখী মেয়েদের ভালবাসে বাঙালি, ঠিক সে ভাবেই ঝিলিকদের মতো অত্যাচারিত মেয়েদের প্রতি দর্শক সহানুভূতিশীল।”
অতঃপর এই প্রশ্নটা এসেই পড়ে যে, এই সব দুঃখকষ্ট কি ইচ্ছে করে সিরিয়ালের বালিকাদের জীবনে ঢোকানো হয়, যাতে টিআরপি বাড়ে? একতা কপূর প্রযোজিত ‘কন্যা’ সিরিয়ালের প্রদর্শক জি টিভির বক্তব্য হল, “আসল কথা, গল্প বলার কায়দা। মানে জোরালো চিত্রনাট্য।” ‘মা’র প্রদর্শক স্টার জলসা জানাল, “ছোটদের নিয়ে গল্প বললে বড়রা যদি তা দেখে আনন্দ পায়, তা হলে বুঝতে হবে টিআরপি উপরের দিকে যাবে। বুঝতে হবে, সে গল্পের মধ্যে কোনও রূপকথার গুণ আছে। যেমন সিন্ডেরেলার দুঃখের কথা শুনে আমরা দুঃখ পাই, আবার তার জিতে যাওয়া দেখে আমরা আনন্দিত হই, সেই রকমই একটা কিছু গুণ থাকার দরকার।”
সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র অবশ্য বললেন একেবারেই আলাদা কথা। তাঁর মতে, বাচ্চা মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানোর কারণ একটাই, মা-বাবার পাশে বসে বাড়ির বাচ্চারাও এই সব সিরিয়াল দেখতে পারবে। তাতে চ্যানেলের নানা ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন পেতে সুবিধে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজার বাড়ানোটাই আসল লক্ষ্য।
এই ধরনের ব্যবসায়িক ধ্যানধারণাকে আমল না দিয়ে ‘মা’-এর পরিচালক দেবাংশু সেনগুপ্ত বলছেন, “শুধু বাচ্চা মেয়েই বা কেন, বাচ্চা ছেলে নিয়ে গল্প দিয়েও সিরিয়াল হিট হতে পারে। যদি চিত্রনাট্য ভাল হয়।” তবে আসল কথাটি বোধহয় এত দিন ধরে পারিবারিক সিরিয়ালে বৌ-শাশুড়ির যে কোঁদল দেখানো হত, এখন আর তা দিয়ে দর্শকের মন ভোলানো যাচ্ছে না। নতুন কিছু খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে টিআরপি বাড়ানোর এক নতুন অস্ত্র, যার উৎসে রয়েছে স্নেহ। আর সেই নতুন অস্ত্রে শান দিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নেমে পড়েছে প্রায় সব চ্যানেল। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ‘সংসার সুন্দর হয় রমণীর গুণে’, ‘আমার নাম বাবিন’, ‘অপরাজিত’। অর্থাৎ বাচ্চাদের নিয়ে সিরিয়ালের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
শেষে একটা ছোট্ট প্রশ্ন: কন্যাসন্তান নিয়ে সিরিয়ালের এই রমরমা বাজার কি কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রবণতা রোধ করতে সাহায্য করবে?
তার উত্তর অবশ্য কোনও চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, বা কোনও প্রযোজক-পরিচালকই দিতে পারেননি। তেমন কোনও তথ্যই যে পাওয়া যায় না এ দেশে। |
|
|
|
|
|