|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ১... |
|
লাইটস,ক্যামেরা,সান ফ্রানসিসকো |
গোটা বাংলা ছবি শু্যট হল আমেরিকায়। এই প্রথম। ছবির নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় লিখলেন শু্যটিংনামা |
ছবির নায়িকা বিকেল চারটেয় ভিসা পেলেন। ফ্লাইট ধরলেন সে রাতেই। বারোটায়।
পৌঁছে এমন আতিথেয়তা পাওয়া গেল যে, মনেই হল না বাড়ি থেকে বহু দূরে আছি আমরা সবাই।
তার মধ্যেই হাড়-ভাঙা খাটুনি। ১৭ দিন ধরে ১৮ ঘণ্টা করে শু্যটিং। প্রতিদিন।
একের পর এক হার্ডল পেরোনো এবং মজা দু’টো জিনিসই প্রচুর পরিমাণে ছিল আমেরিকায়। একটা গোটা বাংলা ছবি বিদেশের মাটিতে এ ভাবেই শু্যট হয়ে গেল।
গোটা ছবি আমেরিকায় শু্যট, বিরাট রিস্ক
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, টনি (পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী) আর সুজিতের (সরকারপ্রযোজক) প্রচুর সাহস আছে। একটা গোটা বাংলা ছবি সান ফ্রান্সিসকোর মতো জায়গায় শু্যট করা চাট্টিখানি কথা নয়। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিরাট একটা রিস্ক আছে। ছবিটা আর পাঁচটা বাংলা ছবির মতো বাজেটে হচ্ছে না। বাজেটটা বিরাট। তবে হ্যাঁ, এটুকু বলতে পারি, ‘অপরাজিতা তুমি’র ভিসুয়ালগুলো কিন্তু একেবারে অন্য রকম হবেযা বাংলা ছবিতে এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। কারণ বিদেশের পটভূমিতে এই স্কেলে তো কোনও ছবি শু্যটই হয়নি।
হয়তো মনে হবে যে আমি একটু বেশিই এগিয়ে কথা বলছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ‘অপরাজিতা তুমি’র কাস্টিংটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং হয়েছে। বিশেষ করে কমলিনী আর পদ্মাপ্রিয়াকে নেওয়াটা। এটা কখনওই বলছি না যে, টালিগঞ্জ থেকে ছবির দুই নায়িকার কাস্টিং হত না, কিন্তু কমলিনী-পদ্মাপ্রিয়ার কাস্টিংটার থেকে ভাল কিছু হতে পারত বলে আমি মনে করি না। ওদের ছবি এখানে এখনও কেউ দেখেনি হয়তো। কিন্তু কী ভীষণ শক্তিশালী অভিনেত্রী সেটা ওদের সঙ্গে কাজ করে বুঝেছি। |
|
সান ফ্রানসিসকো স্কাইলাইনের সামনে |
বিদেশে গিয়ে ‘অপরাজিতা তুমি’ শু্যটিং করার সব চেয়ে বড় আকর্ষণ আমার কাছে কী ছিল জানেন? চরিত্রগুলো। প্রদীপ, ঊষসী, কুহু। যে মানুষগুলো অনেক দিন আগে ওখানে গেছে, সফল হয়েছে, জীবনে কিছুরই অভাব নেই, কিন্তু কোথাও একটা একাকিত্ব থেকে গেছে। এই যে কলকাতায় আমরা মন-টন খারাপ হলে দু’-চার জন বন্ধু মিলে বসে একটু হইচই করে নিই। সেটা ওখানে সম্ভব নয়। এই একাকিত্বটাই সুনীলদার (গঙ্গোপাধ্যায়) গল্পের হৃদয়ে বসে আছে। সারা দিন কাজ, তার পর বাড়ি; স্বামী-স্ত্রী একটা বিরাট বাড়িতে, আর কেউ নেই যে দু’টো কথা বলবে। কারও বাড়ি যেতে গেলে মাইলখানেকের ড্রাইভ। অনাবাসী বাঙালিদের কাছে এটা কিন্তু একটা বিরাট সমস্যা। এবং আমেরিকার বাঙালিদের জীবনের এই গল্পটা বলতে পারবে বলেই ‘অপরাজিতা তুমি’ নিয়ে এতটা উৎসাহিত আমি।
বুম্বাদা, আমিও ডায়েটিং করছি
টনির শু্যটিং মানেই খাওয়া-দাওয়ার একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। যেখানেই শু্যট হয়েছে, সকাল থেকে বিরাট একটা গ্যারেজে শাটার তুলে টেবিল পেতে দেওয়া হত। থরে থরে হরেক রকম খাবার। ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, আমেরিকান, ফল, জুস, ইওগার্ট (দই)... যা চাইবে তা-ই। আমি তো খাই না বেশি। হয়তো একটা আপেল খেলাম আর এক পট ইওগার্ট। এ দিকে রঞ্জনদা (সিনেম্যাটোগ্রাফার রঞ্জন পালিত) আর টনি, দু’জনেই খেতে ভালবাসে। কিন্তু মনে হয় আমার পাল্লায় পড়ে বেচারা টনি একটু ফেঁসে গিয়েছিল। হরেক রকমের খাবার সাজানো, এ দিকে আমি কিছুই খাই না দেখে ওরও বোধহয় একটু লজ্জা-লজ্জা করত। আমি একটা ইওগার্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কী হয়তো একটু ডাল, ও এসে বলত, “বুঝলে বুম্বাদা, আমিও না এখন ডায়েটে আছি।” তার পরেই হয়তো বাড়ির ভেতর গিয়ে, ‘এই, চিকেনটা কী রকম হয়েছে একটু টেস্ট করি’ বলে ভালই সাঁটাল। আসলে টনির একটা মজার ব্যাপার আছে। যত খেতে ভালবাসে, ততই খাবার নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝেই বলত, “চলো, আজ প্যাক-আপের পর একটু ওয়াইন আর প্রন হয়ে যাক।” কিন্তু ওই পর্যন্তই। রাত দু’টোর সময় হোটেলে ফিরে কার আর পার্টি করার ইচ্ছে থাকে বলুন।
আড্ডাটা কিন্তু হল না
এই যে এত জন মিলে বিদেশে গিয়ে এত তোড়জোড় করে শু্যটিং হল, কিন্তু এক ফোঁটাও আড্ডা হল না। হবেটা কী করে? ২৫ দিনের সিডিউলকে যদি ১৭-১৮ দিনে নামাতে হয়, তা হলে আর আড্ডা মারার সময় পাওয়া যায়! কী ভাবে যে শু্যটিং হয়েছেবিশেষ করে দ্বিতীয় সিডিউলটায়। ওখানে তো রাত আটটা-ন’টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। সেটা একটা বিরাট সুবিধে ছিল। ডে-লাইট শটগুলোর জন্য ভালই সময় পাওয়া যেত। তার পর শুরু হত নাইট শু্যট। ন’টার পর। সেই নাইট শু্যট শেষ হতে হতে গড়ে রাত বারোটা-একটা তো হত রোজই। প্যাক-আপ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত দু’টো। আবার পরদিন সকাল আটটায় কল-টাইম। অর্থাৎ পুরো ইউনিট প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘণ্টা শু্যটিং করেছে। |
|
কমলিনীর সঙ্গে |
শুধু যে দিন টনির জন্মদিন ছিল, সে দিন কেক কাটা হবে বলে আমরা ন’টায় প্যাক-আপ করেছিলাম। আসলে রঞ্জনদা তো অন্য জাতের মানুষ। সকালবেলা পর্দা টাঙিয়ে রাতের দৃশ্য শু্যট করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ওঁর কাছে। আগে থেকে শট্ ডিভিশন করে রাখতেন। রাত আটটা থেকে ন’টার মধ্যে ম্যাজিক আওয়ারের দৃশ্যগুলো নিতেন। তার পর আলো পড়লে নাইট শু্যট। সত্যি বলতে, এই ছবিটায় আমার কাজ করার অন্যতম লোভ ছিল রঞ্জনদাকে ক্যামেরা করতে দেখা। মানে সকালবেলা ইন্ডোর শটেও উনি লাইট-ফাইট ব্যবহার করতেন না। পুরো অ্যাভেলেব্ল লাইটে কাজ। অথচ সেই চ্যালেঞ্জ লোকটা কী অনায়াসে নিত! আমার এই প্রথম বার কাজ ওঁর সঙ্গে। এক দিকে এমন এক জন উঁচু দরের শিল্পী, অন্য দিকে এমন মাটির মানুষসত্যি দেখা যায় না।
আসলে টনির ছবি করার স্টাইলটা অন্য রকম। ও গল্পটা বলে কম ডায়ালগে, পারিপার্শ্বিকতার ওপর ক্যামেরা রেখে। তার মধ্যেই নাটক তৈরি করে। সেটাই ওর ইউএসপি। এ ছবিটাও, হলফ করে বলতে পারি, আগের দু’টোর মতোই আবারও মহিলাদের মনের মতো ছবি হবে। গল্পটাও তো তেমনই।
লেফ্ট হ্যান্ড ড্রাইভ... বাপ রে!
সান ফ্রান্সিসকোয় এর আগে এক বারই গিয়েছিলাম। ‘উৎসব’ ছবিটাকে নিয়ে। এ বারেও ঘোরা তেমন হয়নি। ওই শু্যটিং করতে করতে যেটুকু আর কী। গোল্ডেন গেট ব্রিজের কাছে শু্যটিং, ওরে বাব্বা কী শীত! তার পর সিনেমায় কমলিনী-চন্দনদের (অভিনেতা চন্দন রায় সান্যাল) বাড়িটা যেখানে ছিল সমুদ্র, সেখান থেকে একটা টিলা মতো উঠছে, টিলার ওপরে বাড়িটা... খুব সুন্দর। যেখানেই গেছি গাড়িতে। রাতের বেলায় রাস্তায় মজা করার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময়ই হল না। তবে হ্যাঁ, যে দিন সকালবেলায় কল থাকত না, সে দিনগুলোয় খুব হাঁটতাম হোটেলটাকে ঘিরে। তার পর গিয়ে শু্যটিং। আসলে ওখানকার ওয়েদারটা এমন দুর্দান্ত! প্রচুর এনার্জি পাওয়া যায় এত তাজা বাতাস।
আরেকটা মজার ব্যাপার হয়েছিল। সিনেমার প্রয়োজনে প্রচুর গাড়ি চালাতে হয়েছে আমায়। তার জন্য তো আন্তর্জাতিক লাইসেন্স লাগবে। আমার তো সে রকম ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। তা কলকাতার মোটর ভেহিকিল্স ডিপার্টমেন্ট খুব সাহায্য করেছিল। ওদের তখন কী সব সিস্টেম পাল্টাচ্ছে। তার মধ্যেও ওড়ার ঠিক আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং আন্তর্জাতিক লাইসেন্স, দু’টোই আমার হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন ওরা।
তবে ওখানে তো আবার লেফ্ট-হ্যান্ড ড্রাইভ। তার ওপর চালাচ্ছি অন্যের গাড়ি। আর গলি-গালা বলে তো কিছু নেই যে দু’-এক দিন প্র্যাক্টিস করে নেব। সব হাইওয়ে। আর একটু লাগলেই ব্যস্! গদাম! তার মধ্যে গাড়ির মধ্যে ক্যামেরা-ফ্যামেরা নিয়ে ড্রাইভ করা। প্রথম দু’-তিন দিন লেগেছিল প্র্যাক্টিস করতে। তবে সাঁ-সাঁ করে গাড়ি যাচ্ছে দু’পাশ দিয়ে। ডান দিক বাঁ দিক করার উপায় নেই। পাঁচ-ছ’লেনের রাস্তা। নাইট শু্যটও করেছি। খুব টেনশন হত বাবা!
বিকেল চারটেয় ভিসা, ফ্লাইট রাত বারোটায়
|
মজা করেই শু্যটিং হয়েছে, কিন্তু তার আগে টানাপোড়েন তো কিছু কম হয়নি। ইউনিট তো প্রথম বার মুম্বইতে প্রায় ফ্লাইটে উঠতে গিয়ে ফিরে এল। আমরা যারা কাজ করেছি এই ছবিতে, সবাই তো তার আগে তিন মাস কোনও কাজ রাখিনিএই হবে, এই হয়ে গেল, এ রকম অবস্থা। এ দিকে টনিরা গিয়ে ওখানে বসে আছে। কিন্তু ওই ভিসার গণ্ডগোলে সব কিছুই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। আসলে এই ও-ওয়ান আর ও-টু ভিসার ব্যাপারটা খুব দরকারি। আমরামানে আমি আর টনি তো ও-ওয়ান ভিসা পেয়েছি। এটা খুব বড় একটা সম্মান। এখন আমি চাইলে ওখানে গিয়ে আরও পাঁচটা ছবি করে আসতে পারি। বাকিদের ও-টু ভিসা ছিল। আসলে গোটা একটা ছবি। একটা ছুটকো নাচ হলে অনেক সময়ে ট্যুরিস্ট ভিসাতেও ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু অনেক দিনের জন্য প্রফেশনালি কাজ করতে গেলে ও-ওয়ান, ও-টু ভিসা লাগে। শেষের দিকে একটা হাল্কা বিরক্তি আসছিল। অন্য কোনও কাজে মনোযোগও |
কমলিনী |
|
দিতে পারছিলাম না। সে কারণেই শেষে আমি একটা ডেডলাইন দিলাম। হয় এর মধ্যে ভিসা এসো, নইলে ফিরে এসে সকলের নতুন করে ডেট নিয়ে আবার শিডিউল করো। কী ভাগ্যি, সেটা আর করতে হয়নি। তবে পদ্মাপ্রিয়াকে সত্যি পিঠ চাপড়াতে হয়। ও যে দিন ফ্লাই করল সে দিন বিকেল চারটেয় ও ভিসা পায়। আর রাত বারোটায় ফ্লাইট ধরে।
চন্দন বেপাত্তা
চন্দন, পদ্মাপ্রিয়া আর কমলিনীর সঙ্গে এ বারেই প্রথম কাজ করলাম। একেবারে ইয়াং একটা ক্রাউড। ছেলেমানুষিটা মোটামুটি এয়ারপোর্ট থেকেই শুরু করে দিয়েছিল। সবে সান ফ্রান্সিসকোয় নেমেছি। সিকিউরিটি চেকে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ পিছন থেকে এক জোড়া কণ্ঠ“বুম্বাদা!” আমি ভাবছি, এ আবার কী রে, এখানে কে ডাকনামে ডাকে? দেখি টি-শার্ট আর কোয়ার্টার পরা দু’টো ছেলেমেয়ে। চিনতে পারছি না। তার পর বুঝলাম আরে, এ তো আমারই কো-স্টার! চন্দন আর কমলিনী। ওরা আমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে এতটা এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ফ্লাইটে কথা বলিসনি কেন? উত্তরএমনি, এখানে এসে তোমায় চমকে দেব বলে। এই রকম ছেলেমানুষ দু’জন। সেই চন্দন আর কমলিনী কিন্তু যখন মেক-আপ করে ক্যামেরার সামনে আসছে আমূল বদলে যাচ্ছে। একেবারে পোড়-খাওয়া দম্পতি। এই ট্রান্সফর্মেশনটা আমার দারুণ লেগেছে। দারুণ ম্যাচিওরিটি। পদ্মাপ্রিয়াও তেমনি। আমাদের চার জনেরই ভারতীয় রেস্তোরাঁয় একটা দৃশ্য ছিল। দু’টি পোড় খাওয়া দম্পতি ডিনারে গেছে। বেশ কম সময়ে শটটা নেওয়া হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম কী অবলীলায় তাল মিলে গেল আমাদের সবারবয়স এবং অভিজ্ঞতার ফারাক সত্ত্বেও। অথচ বিশ্বাস করুন, সিনটা আমরা এক বারও রিহার্স করিনি। আসলে টিউনিংটা আমাদের চার জনের প্রথম থেকেই দারুণ হয়েছিল। অথচ যে-ই ক্যামেরা অফ্ হল, অমনি এই তিন জন খুনসুটিতে মেতে যেত। এর পিছনে লাগছে। ওর ‘লেগ-পুল’ করছে। একদিন চন্দনের শু্যটিং ছিল না। হঠাৎ জানা গেল সে নিখোঁজ। শেষে তাকে পাওয়া গেল কোন এক ঝিলের ধারে কানে আই-পড লাগিয়ে বসে। এই রকম ছেলেমানুষি করত সব ক’টা।
কমলিনীর সঙ্গে আমার বেশ বোল্ড একটা দৃশ্য আছে। সেই সিনটা করতে গিয়ে মনে পড়ছিল আট বছর আগে ‘চোখের বালি’র প্রায় অমনই একটা দৃশ্যের কথা। রাইমাকে যেমন কথা বলে বলে সহজ করিয়ে নিয়ে সিনটা করিয়েছিলাম, কমলিনীকেও প্রায় সে ভাবেই সহজ করাতে হয়েছে আমায়এ বারও। সিনটা শেষ হওয়ার পর ওর তো প্রায় কান্না-কান্না অবস্থা। এতটাই নাকি টেনস্ড ছিল। ওই এক বারই মনে হয়েছিল মেয়েটা আসলে এখনও ছেলেমানুষ।
সুস্মিতাদি, রানাদারাই গার্জেন
একটা গোটা বাংলা ছবি যদি অন্য কোনও দেশে শু্যটিং হয়, তা হলে সেখানকার বাঙালিদের একটা বিরাট ইনভল্ভমেন্ট না থাকলে ব্যাপারটা মসৃণ ভাবে নামে না। সান ফ্রান্সিসকোতেও সেটাই ঘটল। ওখানকার বাঙালিদের সত্যি জবাব নেই। রানাদা, সুস্মিতাদি, সুরজিৎদা, সুমিতা, সুস্মাদের সঙ্গে আলাপ হওয়াটাই একটা অন্য এক্সপিরিয়েন্স। পুরো ব্যাপারটা যেন একটা বাড়ির মতো। সুস্মিতাদিদের সান ফ্রান্সিসকোর বাড়িটা প্রায় প্রাসাদ।
|
পদ্মাপ্রিয়া |
সিনেমায় সেটাই আমার আর পদ্মাপ্রিয়ার বাড়ি। আর কী দুর্দান্ত মহিলা! সব দিকে সজাগ দৃষ্টি। কে চিনি দেওয়া চা খায়, কে চিনি ছাড়া, এটা প্রথম দিন জেনে নেওয়ার পর আর দ্বিতীয় বার জিজ্ঞাসা করেননি। যেটা অবাক হওয়ার মতো সেটা হল ওঁরা হয়তো রাত দু’টোয় আমাদের হোটেলে ড্রপ করে বাড়ি গেলেন, পরদিন আবার সকাল আটটায় হাসিমুখে হাজির। রানাদা-সুরজিৎদারা সকালে চলে আসতেন শু্যটিং স্পটে। ব্যবসায়ী মানুষ দু’জনেই। শু্যটিং থেকে অফিস চলে যেতেন। আবার বিকেলবেলা চলে আসতেন। আর সুস্মিতাদির মতো মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। একেবারে যেন মিলিটারি। আমাদের গার্জেন। এত ঠান্ডা মাথায় শু্যটিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রক্রিয়াগুলো সামলাতেন, প্রায় একা হাতে, ভাবাই যায় না। শেখার মতো! |
|
বে এরিয়ায় সবাই উত্তেজিত
আর একটা জিনিস দারুণ লাগল। এখান থেকে ওখানে যাঁরা গেছেন, তাঁদের কাছে তো স্বাভাবিক ভাবেই একটা শেকড়ের টানের ব্যাপার আছে। কিন্তু যারা ওখানেই জন্মেছে, বড় হয়েছে, তাদের মধ্যেও মা-বাবারা বেশ একটা বাঙালিয়ানা আনার চেষ্টা করছেন। বাড়িতে সবাই কথা বলেন পরিষ্কার বাংলায়। তার পর ১৬-১৭ বছরের ছেলেপিলেকেও দেখলাম ভূমি, চন্দ্রবিন্দু, রূপমের গান-ফান শোনে। মাথা নেড়ে বলে, “’টিস গুড।” যাদের বয়স তিরিশ-চল্লিশের কোঠায়, তারা ফাটিয়ে আজকাল বাংলা সিনেমা দেখছেন, বাংলা গান শুনছেন। আসলে উত্তম-সুচিত্রার পর বাংলা সিনেমায় এঁদের মননের সঙ্গে যায় এমন ছবি ছুটকো-ছাটকা হত। এখন সংখ্যাটা বেড়েছে। এঁরাও যে করেই হোক সেগুলো দেখছেনও। পরের জেনারেশনকেও নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছেন। এটা অবশ্যই টালিগঞ্জের কৃতিত্ব যে, কলকাতায় বসে তেমন ছবি তৈরি করা যাচ্ছে।
আসলে দূরের মানুষের কাছে পৌঁছনোর পথটা বের করতে হয়। এই যে আমরা ওঁদের কাছে গিয়ে একটা গোটা ছবি শু্যট করলাম, তার একটা তাৎপর্য আছে। ‘অপরাজিতা তুমি’ নিয়ে বে এরিয়ার বাঙালিদের মধ্যে কিন্তু এর মধ্যেই সাড়া পড়ে গেছে। এ বার ছবিটা যখন মুক্তি পাবে, তখন এবং ব্যবসার এই দিকটা নিয়ে টনি, সুজিত, আমি, আমরা সবাই আলোচনা করেছিএটা আশা করাই যায় যে ওখানেও সেটা ভাল চলবে। কারণ ওদের লাইফ আর লাইফস্টাইল, দু’টোই আছে ছবিটায়। এই তো আমরা পৌঁছে শুনলাম ‘নৌকাডুবি’ নাকি ওখানে এত ভাল চলেছে যে ফার্স্ট উইকএন্ডের পর আবার সেকেন্ড উইকএন্ড শো করতে হয়েছে। ওখানে যাঁরা এ দেশের প্রাদেশিক ছবি চালান, তাঁরা তো দারুণ উত্তেজিত ব্যাপারটা নিয়ে। আমরা থাকতে থাকতে ওখানে ‘ইতি মৃণালিনী’ এল। বলিউড এই যে বিরাট ওভারসিজ ব্যবসা করে, মলয়ালম, তামিল, তেলেগু ছবিও বেশ কিছু দিন যে ব্যবসা শুরু করেছে, সেটা তো বাংলা ছবিতেও হতে পারে।
শুধু ওখানকার দর্শকের একটা অভ্যাস করাতে হবে নিয়মিত ওঁদের মননের সঙ্গে খাপ খায় এমন বাংলা ছবি তৈরি করতে হবে, ও দেশে পৌঁছে দিতে হবে।
টালিগঞ্জে ঘরের বাইরে পৌঁছনোর প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। আশা করি সেটা একটা অন্য মাত্রা পাবে ‘অপরাজিতা তুমি’ মুক্তির পর। |
|
|
|
|
|