ফেব্রুয়ারি হইতে অগস্ট, সাত মাসের যাত্রা শেষ হইবার পথে। লিবিয়ার বিদ্রোহীরা সাত মাস ধরিয়া লাগাতার অসীম সাহসে লড়িয়া এই সবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হইয়াছেন। দ্বারপ্রান্তই বলিতে হইবে, কেননা প্রেসিডেন্ট জেনারেল গদ্দাফি সেই ধরনের মানুষ যাঁহার নাট্যে যবনিকাপাত না দেখিলে বিশ্বাস নাই। এখনও-পর্যন্ত পলাতক একনায়ককে যত দিন না ধরা যাইবে, কিংবা তাঁহার পরাজয় স্বীকারের ঘোষণা পাওয়া যাইবে, তত দিন অবধি বিদ্রোহের সাফল্য সম্পূর্ণ বলা যাইবে না। উপরন্তু শোনা যাইতেছে, তিনি বা তাঁহার বাহিনী নাকি অন্তরাল হইতে হুমকি দিতেছেন, লিবিয়া শ্মশান না হওয়া পর্যন্ত তাঁহারা লড়িয়া যাইবেন। অতীতে কিংবা বর্তমানে গদ্দাফি যে ধরনের অত্যাচারের দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার হুমকিমাত্রই গভীর দুশ্চিন্তাজনক। লিবিয়ার বিদ্রোহী নেতৃবর্গ তাহা ভালই জানেন। তাই তাঁহারা আপাতত কোনও রকম উদ্যাপনের চেষ্টাই করিতেছেন না, বরং নিজেদের শক্তি সংহত করিবার প্রয়াসে আছেন। আরও একটি সমস্যা, বিদ্রোহীদের মধ্যে নানা স্বার্থের সংঘর্ষ। রাজধানী ত্রিপোলি যেমন গদ্দাফি-বাহিনীর ঘাঁটি ছিল, তেমনই গত কয়েক মাস যাবৎ বিদ্রোহীদের কেন্দ্র ছিল পূর্ব লিবিয়ার শহর বেনগাজি। আফ্রিকার অন্যান্য নানা দেশের মতোই, লিবিয়াতেও জাতি-উপজাতি ভিত্তিক অসদ্ভাব ও আঞ্চলিক বৈষম্য খুব তীব্র। ইতিমধ্যেই বেনগাজি শিবিরের সহিত মিসরাতা ও নাফুসা অঞ্চলের বিদ্রোহী সৈন্যদের মতান্তরের ইঙ্গিত মিলিতেছে। কিছু দিন আগে বেনগাজি-র মিলিটারি কমান্ডার আবদুল ফতা ইউনিস যে ভাবে আততায়ীর হাতে নিহত হইয়াছেন, তাহার পিছনেও সম্ভবত এই অন্তর্দ্বন্দ্ব।
সাফল্যের যেটুকু আভাস মিলিতেছে, বহির্দুনিয়া অবশ্য তাহাতেই যথেষ্ট নিশ্চিন্ত। একেই সাত মাস নিরবচ্ছিন্ন রক্তক্ষয় ও নেটো-র অভিযানের নেপথ্যে নিরন্তর মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে লিবিয়া যে ভাবে দিনাতিপাত করিতেছিল, তাহাতে উদ্বেগের শেষ ছিল না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি নেটো-র লিবিয়া অভিযানের প্রাণপুরুষ: তিনি ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন উভয়েই বলিয়াছেন, ক্ষয়ক্ষতির বিপুলতা ও পাল্টা মারের সম্ভাবনা বিচার করিয়া নেটো বাহিনী এখনও কিছু দিন লিবিয়ায় অধিষ্ঠান করিবে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীরা খানিকটা সংহত হইয়া উঠিতে পারিবে, আঞ্চলিক সংঘাত কমাইয়া একটি সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্তে আসিতে পারিবে, এই আশা ছাড়া গত্যন্তর নাই।
বিদ্রোহীদের ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল-এর ঘোষণা, আগামী আঠারো মাসের মধ্যে আইন ও গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নূতন প্রশাসন নির্মিত হইবে। ১৯৬৯ সাল হইতে একক একনায়কের ক্ষমতার অধীন, প্রবল সামাজিক ও অর্থনৈতিক দমনের পীঠস্থান লিবিয়ায় যে এমন একটি ঘোষণা ২০১১ সালে সম্ভব হইল, তাহাই সাত মাসের বিদ্রোহের বিরাট সাফল্য। এ বার পরবর্তী লড়াই। সেই লড়াই-এ নামার আগে বিদ্রোহীরা নিশ্চয়ই গর্বিত হইতে পারেন এই ভাবিয়া যে, আফ্রিকার অনেক দেশেই এমন পরিস্থিতিতে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হইত, অথচ লিবিয়ায় কিন্তু তাঁহারা তেমন কিছু ঘটিতে দেন নাই। বিদ্রোহী পূর্ব লিবিয়া ও গদ্দাফি-সমর্থক পশ্চিম লিবিয়া এত দিনে দুই টুকরা হইয়া যাইতে পারিত। তাহা হয় নাই। বিদ্রোহীরা সমগ্র লিবিয়াকে একত্র রাখিতে বদ্ধপরিকর। এই সুদৃঢ় লক্ষ্যাভিমুখই বজায় থাকুক, এবং স্বার্থসংঘাত অপসৃত হউক, ইহাই কাম্য। লড়াই-এর আরও ধাপ বাকি আছে ঠিকই, তবে সর্বাপেক্ষা কঠিন ধাপটিই পার হওয়া গিয়াছে, সেই সন্তোষ ও প্রত্যয় রহিল। |