|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
গল্প মন ছুঁল, ‘দ্য কিড’ হল না |
বাচ্চা ছেলে সোহম অনবদ্য। কিন্তু রুদ্রনীল কিছু কিছু জায়গায়, হয়তো বা
খিদের মুখে অতিভক্ষণ করে ফেলেছেন। লিখছেন শিলু চট্টোপাধ্যায় |
এক যে ছিল বাবা আর তার ছিল এক ছেলেতাই নিয়ে ‘চ্যাপলিন’-এর গল্প।
ছেলেটির বয়স বছর দশেকের কাছাকাছি। আর বাবা ধরুন পঁয়ত্রিশের আশেপাশে। বস্তির এক ঘরে বাবা বংশী দাস তার ছেলেকে নিয়ে থাকে। বংশী কী করে? বংশী জোকার সাজে আর পড়শিদের নিয়ে গড়া এক দল নিয়ে বড়লোকদের বাড়ির আনন্দ অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের মজার জোগান দেয়। সে যে-সে জোকার সাজে না। চ্যাপলিন সাজে। শুধু মেক-আপ নয়বংশী চ্যাপলিনের মতো হাঁটে, ওঁর মতো করে টুপি খুলে অভিবাদন করে, ওঁর মতো করে পড়ে যায়মানে বংশীর পুরো সত্তাটাই চ্যাপলিন।
এতে আর ক’টাকা রোজগার হয়! তাই অনেক দিনই পেটে খিদে নিয়ে কেটে যায়। তখন বাবা আর ছেলে মিলে স্বপ্ন দেখে। ছেলেটি ঘুমের মধ্যে নিজের জন্মদিনের ধুমধাম দেখে আর বাবা স্বপ্ন সাজায় অকিঞ্চিৎকর জোকার থেকে সম্মানিত শিল্পী হয়ে ওঠা নিয়ে। অবশেষে আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত সুযোগবংশী তাঁর চ্যাপলিনত্ব দিয়ে সাফল্যকে জয় করার মুখে।
হঠাৎই কালো মেঘবাচ্চাটির মারণরোগ। বাচ্চাকে তার আগামী জন্মদিনের উপহার কি বাবা দিতে পারবে? এক দিকে ছেলের অসুখ আর অন্য দিকে নিজের সাফল্যের দাবি। ছেলেকে কি তার স্বপ্ন সাকার করে দিতে পারবে বংশী? এক বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রেক্ষাগৃহ। দর্শক এক জন। মঞ্চেও এক জনই। বংশী দাস শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তাঁর ছেলের জন্মদিনেহয়তো বা শেষ জন্মদিনে। জগৎ সংসারকে দূরে সরিয়েশুধু বাবা আর তার ছেলে।
|
|
চ্যাপলিন
রুদ্রনীল, সোহম, মীর, সৃজিত, রচিতা |
এই মন-ছোঁয়া গল্প নিয়ে ছবি‘চ্যাপলিন’। শুধু তার নজর-কাড়া পোস্টারের জন্যই নয়‘চ্যাপলিন’ নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা। সে ভাবে হয়তো কোথাও বলা নেই, তবে এ ছবির অনুপ্রেরণা হয়তো শুধু চার্লি চ্যাপলিন ননএ ছবির মূল সুরের সঙ্গে চার্লস চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর অনেক জায়গাতেই মিল আছে। চ্যাপলিন নিজের সন্তানকে তিন দিনের মাথায় হারিয়ে শুরু করেছিলেন তাঁর ছবি ‘দ্য কিড’। উনি ট্র্যাম্প আর সঙ্গে এক ফেলে রেখে যাওয়া বাচ্চা। জন্মদিনে পারফরম্যান্স নয়; এক জন জানলার কাচ ভাঙতেন আর এক জন সারাতেন। এই কিডকেও ট্র্যাম্পের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিলতাই নিয়েই সে ছবির পরিণতি। সেই নির্বাক ছবিকে প্রায় একশো বছর পরের সমাজে এনে ফেলা আর সেই বিশ্ববন্দিত ব্রিটিশ অভিনেতাকে অনুকরণের যে চেষ্টা এ ছবিতে করা হয়েছে তা বোধহয় বাংলা ছবিতে অভূতপূর্ব।
যেটা ‘দ্য কিড’কে ‘চ্যাপলিন’ করার এই দুঃসাহসী প্রচেষ্টাকে আরও অন্য মাত্রা দেয়, তা হল এ ছবির নির্মাতারা অনেক জায়গাতেই বাজারের সঙ্গে সখ্য করার লোভ সামলেছেন। ‘আর্টিস’ বংশী দাসের অনুপ্রেরণা পোসেনজিৎখুব স্বাভাবিক। বিশেষ চরিত্রে এ ছবিতে প্রসেনজিৎকে পর্দায় আনাই যেত। কিন্তু আনা হয়নি। এই পরিমিতিবোধটা ভাল লাগে। একই প্রাপ্তমনস্কতা ছবির শেষেগল্প শেষ করাটা যেন দর্শকদের কল্পনার দায়িত্ব। আবার সেই নিরিখেই হল মালিকের সঙ্গে মাঝরাতে বংশী ও সহসম্প্রদায়ের হাতাহাতির দৃশ্যটি বেমানান লাগে।
বেশ কিছু অসাধারণ মুহূর্ত আছে এ ছবিতেবাবা ছেলের পাউরুটির মাংস (আসলে জলে পাউরুটি) খাবার বা খাওয়া-খাওয়া খেলার দৃশ্যটির কথা প্রথমেই মনে পড়ে। ছবির প্রায় ক্লাইম্যাক্সে রূপছায়ার মঞ্চে বংশীর একক অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে এ ছবির হাই-পয়েন্ট। এ রকম মণিমুক্তো আরও কিছু ছবি জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
আর আছে সোহমের উপস্থিতি। সোহম এ ছবির দ্য কিড। সোহমের বয়েসি কাউকে দিয়ে যে কোনও ‘অভিনয়ই’ মুশকিলদরদি, চোখে জল-আনা অভিনয় নিশ্চয়ই খুব কঠিন। একটা উদাহরণ দেওয়াই যায়। বাচ্চাটি এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট বড় যে, সত্যি সত্যি কেক কেটে, বেলুন ফুলিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে জন্মদিন তার কোনও মতেই হবে না। সে দুঃখ যে অপারগ বাবার সামনে করতে নেই সে বোধটুকুও তাকে তার ছোট্ট জীবন ইতিমধ্যেই শিখিয়ে দিয়েছে। তাই একা একাবাবার অনুপস্থিতিতেসে মিছি মিছি জন্মদিনের কেক কাটা, ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভানোর অনুষ্ঠান করে। সোহম এ দৃশ্যে অনবদ্য।
এ কথা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘চ্যাপলিন’ রুদ্রনীলের ছবি। কারণ রুদ্রনীলই চ্যাপলিন। উনি সন্দেহাতীত প্রতিভা। এর আগে অন্য বহু ছবির মতো এ ছবিতেও বহু জায়গায় তার ছাপ পড়েছে। আবার কিছু কিছু জায়গায়, হয়তো বা খিদের মুখে, অতিভক্ষণ হয়ে গেছে।
বংশীর পাশে সতীর্থ জাফরের চরিত্রে মীর অভিব্যক্তিতে বাঙ্ময় - তবে রেডিও, টিভির প্রথিতযশা সঞ্চালকের পরিশীলিত উচ্চারণ জাফরের জন্য একটু বেমানান ঠেকেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। টিভি রিয়্যালিটি শো-এর পরিচালকের ভূমিকায় তিনি যথাযথ। এ ছবির নায়িকা রচিতা। নবাগতা, সুন্দরী, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি তাঁর চরিত্রের প্রতি অনুগত।
‘চ্যাপলিন’ অনেকেরই মন ছোঁবেঅনেক বাবা তাঁদের ছেলেদের হয়তো বা বুকের আরও একটু কাছে টেনে নেবেন। এমন সখ্য না থাকার কষ্টে মন খারাপ করবেন অনেক একা পড়ে থাকা বাবা, অনেক দূরে সরে যাওয়া ছেলে। এ এক অন্য রকম আবেগঘন ছবি।
তবু ‘চ্যাপলিন’ হয়তো বা মন ছোঁয়া থেকে মনে রাখার ছবি হয়ে উঠতে পারবে না। দু’টো সম্ভাব্য কারণের কথা মনে আসছে। বংশী আর চ্যাপলিন এ ছবিতে বড় বেশি এক হয়ে গেছে। ‘দ্য কিড’-এ সারা ছবিতে চ্যাপলিন চ্যাপলিনের মতোই করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ছবিতে দু’টো আলাদা চরিত্র আঁকার কথা ভাবাই যেত। মানুষ বংশীকে আলাদা করে পেলে হয়তো বা তার চ্যাপলিন হওয়াটা আরও বেশি মন কাড়ত। সেটা হয়নি বলেই মূল চরিত্রের শক্তিমান অভিনেতাকেও মাঝে মাঝে ক্লান্তিকর লাগে, অতি অভিনয়ের দোষে অভিযুক্ত হতে হয়। রুদ্রনীল এবং পরিচালক অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এই জায়গাটায় আর একটু নজর দিতেন, তা হলে এ ছবিকে দশের মধ্যে এখনকার সাতের বদলে অনায়াসে সাড়ে আট বা তার বেশি দেওয়া যেত।
আর সব শেষে আর একটা প্রশ্ন থেকে যায়। বাচ্চাটির মারণরোগ বাদ দিলে কি ছবিটা দাঁড়াত না? বাবা নিজের সদ্য পাওয়া সাফল্যের জন্মদিন উদ্যাপন না করে, তাঁর শুরু না হওয়া শিল্পীজীবনকে (যেখান থেকে দু’জনে দু’বেলা পেটপুরো খেতে পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা) বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, ছেলের আবদার মতো জন্মদিনের একক অনুষ্ঠান করছেনসে-ও কি কম বড় হিউম্যান ড্রামা?
চ্যাপলিন বোধহয় খুশিই হতেন। |
|
|
|
|
|